11 best poems of Rabindranath Tagore


          যেতে নাহি দিব

        
দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশুন্য পল্লীপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্নবাতাসে। স্নিগ্ধ অশ্বত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিনি জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে।  যেন রৌদ্রামায়ি রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম -
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।।

গিয়েছে আশিন। পূজার ছুটির শেষে
ফিরে  যেতে হবে আজি বহুদূর দেশে
 কর্মস্থানে।  ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিস-পত্র দরাদড়ি লয়ে -
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ ঘরে, ও ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার -
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে। বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে, যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা।  আমি বলি,  'এ কি কান্ড !
এত ঘট, এত পট, হাঁড়ি সরা ভান্ড,
বোতল বিছানা বাক্স, রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে ! কিছু এর রেখে যাই,
কিছু লই সাথে ।'

                সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনজন।  'কি জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে !
সোনামুগ সরুচাল সুপারি ও পান,
ও হাড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভান্ড ভালো রাই সরিষার তেল,
আমসত্ত্ব আমচুর , সেরদুই দুধ ;
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধ-বিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে -
মাথা খাও ভুলিও না, খেয়ো মনে করে ।'
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পর ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে , কহিলাম ধীরে
'তবে আসি' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু-'পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল-অশ্রুজল করিল গোপন ।

বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের।  এতক্ষন
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ;
দুটি অন্য মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া অসিত ঘুমে - আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে।  এত বেলা হয়ে যায় ,
নাই স্নানাহার।  এতক্ষন ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে  মোর কাছে কাছে ঘেঁষে
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন।  শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কি জানি কি ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল।  কহিনু যখন
'মা গো, আসি' সে কহিল বিষণ্ণনয়ন
ম্লান মুখে , 'যেতে আমি দিব না তোমায়। '
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধৰিলে না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার ,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল 'যেতে আমি দিব না তোমায়। '
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।।

                 ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কি শক্তি পেয়ে
কহিলি এমন কথা এত স্পর্ধাভরে
'যেতে আমি দিব না তোমায়' ! চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনি, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্তক্ষুদ্রদেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুক-ভরা স্নেহ !
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যাক্ত করা সাজে
এ জগতে।  শুধু বলে রাখা জিতে দিতে ইচ্ছা নাহি
হেনো কথা কে বলিতে পারে
যেতে নাহি দিবো।  শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববানী , সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেলো মোরে ;
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ'রে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন -
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন ।।

চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত নত  শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে।  তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে।  বহে খর বেগ
শরতের ভরা গঙ্গা।  শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে।  দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগযুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরেননি পেইন চেয়ে ফেলিনু নিঃশ্বাস ।।

কি গভীর দুঃখে  মগ্ন সমস্ত আকাশ ,
সমস্ত পৃথিবী ! চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
'যেতে আমি  দিব না তোমায়' ! ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধন্নিতেছে চোরকাল অনাদ্যান্ত রবে
'যেতে নাহি দিব। ' জিতে নাহি দিব। ' সবে
কহে , 'যেতে নাহি দিব। ' তৃণ ক্ষুদ্র অতি
 তারেও বাঁধিয়া রাখে মাতা বসুমতী
কহিছে প্রানপনে , 'যেতে নাহি দিব। '
 আয়ুক্ষীণ দীপঃমুখে শিক্ষা নিব-নিব  -
 আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে,
কহিতেছে শতবার 'যেতে দিব না রে ' ।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমরতো ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা , সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন 'যেতে নাহি দিব ' । হায় ,
তবে যেতে দিতে হয় , তবে চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদিকাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী  সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত - ব্যগ্রবাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
'দিব না দিব না যেতে 'ডাকিতে ডাকিতে
হুহু করে তীব্র বেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-উর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
'দিব না দিব না যেতে ' । নাহি শুনে কেউ,
নাহি কোনো সাড়া ।।

                       চাই দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্বমর্মভেদী করুন ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে।  শিশুর মতন
বিশ্বের  অবোধ বাণী।  চিরকাল ধরে
যাহা পায়  তাই সে হারায় ; তবু তো রে
শিথিল হলো না মুষ্টি , তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুন্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
যেতে নাহি দিব ' । ম্লানমুখ, অশ্রু আঁখি,
দন্ডে দন্ডে  পলে পলে টুটিছে গরব ,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব -
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধকণ্ঠে কয়
'যেতে নাহি দিব' । যতবার পরাজয়
ততবার কহে , 'আমি  ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ?
আমার আকাঙ্খা-সম এমন অকুল
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর !
এত বলি দর্প ভরে করে সে প্রচার
'যেতে নাহি দিব' । তখনি দেখিতে পায় ,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি সম উড়ে চলে যায়
একটি নিঃশ্বাসে তার আদরের ধন ;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন ,
ছিন্নমূল তরুসম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির।  তবু প্রেম বলে ,
'সত্যভঙ্গ হবে না বিধির ।আমি তাঁর
পেয়েছি সাক্ষর দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির অধিকারলিপি । তাই স্ফীতবুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীন তনুলতা
বলে মৃত্যু তুমি নাই । - হেনো গর্বকথা
মৃত্যু হাসে বসি । মরনপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার , বিসন্ননয়ন 'পরে
অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশংকাভরে
চির কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা
তানিয়া রেখেছে এক বিষাদ কুয়াশা
বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলের ঘিরে
স্তব্ধ সকাতর।  চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া -
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন মেঘের সে মায়া ।।

তাই আজি শুনিতেছি তরুর মর্মরে
এতো ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যাভরে
মধ্যান্যের তপ্তবায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র  লয়ে।  বেলা ধীরে যায় চলে
চ্যা দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর মাঝে । শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী।
দেখিলাম তার সেই ম্লানমুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ , মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।।


                     ১৪০০ সাল 


             আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
                     কৌতুহলভরে,
             আজি হতে শতবর্ষ পরে !
আজিকার নব বসন্তের প্রভাতের আনন্দের
                     লেশমাত্র ভাগ,
আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান,
             আজিকার কোনো রক্তরাগ -
অনুরাগে সিক্ত করি পারিব কি পাঠাইতে
                         তোমাদের করে,
             আজি হতে শতবর্ষ পরে  ?।

তবু তুমি একবার           খুলিয়া দক্ষিণদ্বার
               বসি বাতায়নে
সুদূর দিগন্তে চাহি            কল্পনায় অবগাহি
               ভেবে দেখো মনে -
         একদিন শতবর্ষ আগে
চঞ্চল পুলকরাশি            কোন স্বর্গ হতে ভাসি
         নিখিলের মর্মে আসি লাগে,
নবীন ফাল্গুনদিন           সকল-বন্ধন-হীন
                   উন্মত্ত অধীর ,
উড়ায়ে কাঞ্চল পাখা       পুষ্পরেণুগন্ধমাখা
                    দক্ষিণসমীর
সহসা আসিয়া ত্বরা         রাঙায়ে দিয়েছে ধরা
                 যৌবনের রাগে,
              তোমাদের শতবর্ষ আগে।
সেদিন উতলা প্রাণে,        হৃদয় মগ্ন গানে,
                 কবি এক জাগে -
কত কথা পুষ্পপ্রায়          বিকশি তুলিতে চায়
                   কত অনুরাগে,
               একদিন শতবর্ষ আগে ।।

                আজি হতে শতবর্ষ পরে
এখন করিছে গান            সে কোন নতুন কবি
                 তোমাদের ঘরে !
আজিকার বসন্তের           আনন্দ-অভিবাদন
              পাঠায়ে দিলাম তার করে।
আমার বসন্ত গান             তোমার বসন্তদিনে
             ধ্বনিত হউক ক্ষণতরে -
হৃদয়স্পন্দনে তব,             ভ্রমরগুঞ্জনে নব,
                      পল্লবমর্মরে
               আজি হতে শতবর্ষ পরে ।।


                             বলাকা 


সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
            আঁধারে মলিন হলো যেন খাপে ঢাকা
                             বাঁকা তলোয়ার !
     দিনের ভাঁটার  শেষে রাত্রির জোয়ার
এলো তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে ;
            অন্ধকার গিরিতটতলে
                       দেওদার-তরু সারে সারে ;
মনে হলো , সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে ,
       বলিতে না পরে স্পষ্ট করি
অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি ।।

                     সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে
                              সন্ধ্যার গগনে
           শব্দের বিদ্যুৎছটা শূন্যের প্রান্তরে
মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে।
                            হে হংসবলাকা,
              ঝঞ্ঝামদরসে-মত্ত তোমাদের পাখা
                   রশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে
বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।
                              ওই পক্ষধ্বনি,
                শব্দময়ী অপ্সররমণী ,
গেলো চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি।
                        উঠিল শিহরি
            গিরিশ্রেণী তিমিরমগন ,
                       শিহরিল দেওদার-বন ।।
 
                       মনে হল এ পাখার বাণী
                                      দিল আনি
                             শুধু পুলকের তরে
                    পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে
                              বেগের আবেগ।
               পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ ;
                          তরুশ্রেণী চাহে পাখা মেলি
                               মাটির বন্ধন ফেলি
                ওই শব্দ রেখা ধ'রে চকিতে হইতে দিশাহারা,
                          আকাশের খুঁজিতে কিনারা।
                এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি
                                         সুদূরের লাগি ,
                                  হে পাখা বিবাগি !
            বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে -
                    'হেথা নয় , হেথা নয়, আর কোনখানে !
                             
                          হে হংসবলাকা ,
               আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিয়ে স্তব্ধতার ঢাকা।
                         শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে
                                       শূন্যে জলে স্থলে
                         অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল।
                                            তৃণ দল
                        মাটির আকাশ-'পরে ঝাপটিছে ডানা  ;
                    মাটির আঁধার-নিচে, কে জানে ঠিকানা,
                         মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা
                                 লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা।
                                         দেখিতেছি আমি আজি -
                                                 এই গিরিরাজি
                          এই বন চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়
               দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে , অজানা হইতে অজানায়।
                                  নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে
                      চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে  ।।

                       
                                   শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে
                                           অলক্ষিতে পথে উড়ে চলে
                 অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফুট সুদূর যুগান্তরে।
                                        শুনিলাম আপন অন্তরে
                          অসংখ্য পাখির সাথে
                                        দিনে রাতে
                  এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো - অন্ধকারে
                               কোন পার হতে কোন পারে।
                   ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার এ গানে
                              'হেথা নয় অন্য কোথা , অন্য কোথা , অন্য কোনখানে !'



               বসুন্ধরা

আমারে ফিরায়ে লহ ওই বসুন্ধরে
কোলের সন্তান তব কোলের ভিতরে
বিপুল অঞ্চলতলে।  ওগো মা মৃন্ময়ী ,
তোমার মৃত্তিকা মাঝে ব্যাপ্ত হয়ে রই
দিগ্বিদিকে আপনারে দিই বিস্তারিয়া
বসন্তের আনন্দের মতো।  বিদারিয়া
এ বক্ষপঞ্জর , টুটিয়া পাষানবন্ধ
সঙ্কীর্ণ প্রাচীর , আপনার নিরানন্দ
অন্ধ কারাগার - হিল্লোলিয়া , মর্মরিয়া
কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া ,
শিহরিয়া, সচকিয়া আলোকে পুলকে ,
প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে
প্রান্ত হতে প্রান্তভাগে , উত্তরে দক্ষিণে ,
পুরবে পশ্চিমে ; শৈবাল শাদ্বলে তৃণে
শাখায় বল্কলে পত্রে উঠি সরসিয়া
নিগুঢ়জীবনরসে ; যাই পরশিয়া
স্বর্ণশীর্ষে-আনমিত শস্যক্ষেত্রতল
অঙ্গুলির আন্দোলনে ; নব পুস্পদল
করি পূর্ণ সংগোপনে সুবর্ণলেখায়
সুধাগন্ধে মধুবিন্দুভারে। নীলিমায়
পরিব্যাপ্ত করি দিয়া মহাসিন্ধুনীর
তীরে তীরে করি নৃত্য স্তব্ধ ধরণীর
অনন্ত কল্লোলগীতে ; উল্লসিত রঙ্গে
ভাষা প্রসারিয়া দিই তরঙ্গে তরঙ্গে
দিক-দিগন্তরে ; শুভ্র -উত্তরীয় -প্রায়
শৈলশৃঙ্গে বিছাইয়া দিই আপনায়
নিস্কলঙ্ক নীহারের উত্তুঙ্গ নির্জনে
নিঃশব্দ নিভৃতে ।।

                         যে ইচ্ছা গোপনে মনে
উৎসসম উঠিতেছে অজ্ঞাতে আমার
বহুকাল ধ'রে, হৃদয়ের চারি ধার
ক্রমে পরিপূর্ণ করি বাহিরিতে চাহে
উদবেল উদ্দাম মুক্ত উদার প্রবাহে
সিঞ্চিত তোমায় - ব্যথিত সে বাসনারে
বন্ধমুক্ত করি দিয়া শতলক্ষ ধারে
দেশে দেশে দিকে দিকে পাঠাব কেমনে
অন্তর ভেদিয়া।  বসি শুধু গৃহকোণে
লুব্ধচিত্তে করিতেছি সদা অধ্যয়ন
দেশে দেশান্তরে কারা করেছে ভ্রমণ
কৌতূহলবশে ; আমি তাহাদের সনে
করিতেছি তোমারে বেষ্টন মনে মনে
কল্পনার জালে ।।
                সুদুর্গম দূরদেশে -
পথশূন্য তরুশূন্য প্রান্তর অশেষ
মহাপিপাসার রঙ্গভূমি ; রৌদ্রলোকে
জ্বলন্ত বালুকারাশি সূচি বিঁধে চোখে;
দিগন্ত বিস্তৃত যেন ধুলিশয্যা - 'পরে
জ্বরাতুরা বসুন্ধরা লুটাইছে পড়ে
তপ্তদেহ, উষ্ণশ্বাস বহ্নিজ্বালাময়
শুষ্ককণ্ঠ, সঙ্গহীন, নিঃশব্দ, নির্দয়।
কতদিন গৃহপ্রান্তে বসি বাতায়নে
দূর দূরান্তরের দৃশ্য আঁকিয়েছি মনে
চাহিয়া সম্মুখে। - চারি দিকে শৈলমালা ,
মধ্যে নীল সরোবর নিস্তব্ধ নিরালা
স্ফাটিকনির্মল স্বচ্ছ ; খণ্ডমেঘগণ
মাতৃস্তনপানরত শিশুর মতন
পড়ে আছে শিক্ষার আঁকড়ি ; হিমরেখা
নীলগিরিশ্রেণী -'পরে দূরে যায় দেখা
দৃষ্টিরোধকরি, যেন নিশ্চল নিষেধ
উঠিয়াছে সারি সারি স্বর্গ করি ভেদ
যোগমগ্ন ধুর্জটির তপোবনদ্বারে।
মনে মনে ভ্রমিয়াছি দূর সিন্ধুপারে
মোহামেরুদেশে - যেখানে লয়েছে ধরা
অনন্তকুমারীব্রত , হিমবস্ত্র-পরা
নিঃসঙ্গ , নিস্পৃহ , সর্বআভরণ-হীন ;
যেথা দীর্ঘ রাত্রিশেষে ফিরে আসে দিন
শব্দশূন্য সংগীতবিহীন ; রাত্রি আসে ,
ঘুমাবার কেহ নাই , অনন্ত আকাশে
অনিমেষ জেগে থাকে নিদ্রাতন্দ্রাহত
শূন্যশয্যা মৃতপুত্রা জননীর মত।
নুতন দেশের নাম যত পাঠ করি ,
বিচিত্র বর্ণনা শুনি, চিত্ত অগ্রসরি
সমস্ত স্পর্শিতে চাহে।  - সমুদ্রের তটে
ছোট ছোট নীলবর্ণ পর্বতসঙ্কটে
একখানি গ্রাম ; তীরে শুকাইছে জাল ,
জলে ভাসিতেছে তরী , উড়িতেছে পাল,
জেলে ধরিতেছে মাছ, গিরিমধ্যপথে
সংকীর্ণ নদীটি চলি আসি কোনোমতে
আঁকিয়া বাঁকিয়া।  ইচ্ছা করে, সে নিভৃত
গিরিক্রোড়ে -সুখাসীন ঊর্মিমুখরিত
লোকনীড়খানি হৃদয়ে বেষ্টিয়া ধরি
বাহুপাশে।  ইচ্ছা করে, আপনার করি
যেখানে যা কিছু আছে; নদীস্রোতনীরে
আপনারে গলাইয়া দুই তীরে তীরে
নব নব লোকালয়ে করে যাই দান
পিপাসার জল, গেয়ে যাই কলগান
দিবসে নিশীথে ; পৃথিবীর মাঝখানে
উদয়সমুদ্র হতে অস্তসিন্ধু-পানে
প্রসারিয়া আপনারে তুঙ্গগিরিরাজি
আপনার সুদুর্গম রহস্যে বিরাজি ;
কঠিন পাষানক্রোড়ে তীব্র হিমবায়ে
মানুষ করিয়া তুলি লুকায়ে লুকায়ে
নব নব জাতি।  ইচ্ছা করে মনে মনে ,
স্বজাতি হইয়া থাকি সর্বলোক-সনে
দেশে দেশান্তরে ; উষ্ট্রদুগ্ধ করি পান
মরুতে মানুষ হই আরব-সন্তান
দুর্দম স্বাধীন; তিব্বতের গিরিতটে
নির্লিপ্ত প্রস্তরপুরী-মাঝে বৌদ্ধমঠে
করি বিচরণ। দ্রাক্ষাপায়ই পারসিক
গোলাপকাননবাসী, তাতার নির্ভীক
অশ্বারূঢ় , শিষ্টাচারী সতেজ জাপান ,
প্রবীণ প্রাচীন চীন নিশিদিনমান
কর্ম -অনুরত - সকলের ঘরে ঘরে
জন্মলাভ ক'রে লই  হেন্ ইচ্ছা করে।
অরুগ্ন বলিষ্ঠ হিংস্র নগ্ন বর্বরতা -
নাহি কোনো ধর্মাধর্ম , নাহি কোনো প্রথা
নাহি কোনো বাধাবন্ধ ; নাই চিন্তাজ্বর ,
নাহি কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব , নাই ঘর পর ,
উন্মুক্ত জীবনস্রোত বহে দিনরাত
সম্মুখে আঘাত করি সহিয়া আঘাত
অকাতরে ; পরিতাপজর্জর পরানে
বৃথা ক্ষোভে নাহি চায় অতীতের পানে ,
ভবিষ্যৎ নাহি হেরে মিথ্যা দুরাশায় ,
বর্তমান তরঙ্গের চূড়ায় চূড়ায়
নৃত্য ক'রে চলে যায় আবেগী উল্লাসি -
উচ্ছৃঙ্খল সে জীবন সেও ভালোবাসি ;
কতবার ইচ্ছা করে সেই প্রাণঝড়ে
ছুটিয়া চলিয়া যাই পূর্ণপাল-ভরে
লঘুতরীসম ।।

                     হিংস্র ব্যাঘ্র অটবীর -
আপন প্রচন্ড বলে প্রকান্ড শরীর
বহিতেছে অবহেলে ; দেহ দীপ্তোজ্বল
অরণ্য মেঘেরতলে প্রচ্ছন্ন অনল
বজ্রের মতন , রুদ্র মেঘমন্দ্রস্বরে
পরে আসি অতর্কিতে শিকারের 'পরে
বিদ্যুতের বেগে ; অনায়াস সে মহিমা ,
হিংসাতীব্র সে আনন্দ , সে দীপ্ত মহিমা,
ইচ্ছা করে , একবার লভি তার স্বাদ।
ইচ্ছা করে বার বার মিটাইতে সাধ
পান করি বিশ্বের সকল পাত্র হতে
আনন্দমদিরা ধারা নব নব স্রোতে ।।

হে সুন্দরী বসুন্ধরে, তোমা-পানে  চেয়ে
কতবার প্রাণ মোর উঠিয়াছে গেয়ে
প্রকান্ড উল্লাসভরে।  ইচ্ছা করিয়াছে
সবলে আঁকড়ি ধরি এ বক্ষের কাছে
সমুদ্রমেখেলা-পরা তব কটিদেশ,
প্রভাতরৌদ্রের মতো অনন্ত অশেষ
ব্যাপ্ত হয়ে দিকে দিকে অরণ্যে ভূধরে
কম্পমান পল্লবের হিল্লোলের 'পরে
করি নৃত্য সারাবেলা করিয়া চুম্বন
প্রত্যেক কুসুমকলি , করি আলিঙ্গন
সঘন কোমল শ্যাম তৃণক্ষেত্রগুলি ,
প্রত্যেক তরঙ্গ- 'পরে সারাদিন দুলি
আনন্দদোলায় ; রজনীতে চুপে চুপে
নিঃশব্দচরণে বিশ্বব্যাপী নিদ্রারূপে
তোমারসমস্ত পশু-পক্ষীর নয়নে
নীড়ে নীড়ে গৃহে গৃহে গুহায় গুহায়
করিয়া প্রবেশ , বৃহৎ অঞ্চল-প্রায়
আপনারে বিস্তারিয়া ঢাকি বিশ্বভূমি
সুস্নিগ্ধ আঁধারে ।।

                         আমার পৃথিবী তুমি
বহু বরষের।  তোমার মৃত্তিকা-সনে
আমারে মিশায়ে লয়ে অনন্ত গগনে
অশ্রান্ত চরণে করিয়াছ প্রদক্ষিণ
সবিতৃমণ্ডল অসংখ্য রজনীদিন
যুগযুগান্তর ধরি ; আমার মাঝারে
উঠিয়াছে তৃণ তব, পুস্প ভারে ভারে
ফুটিয়াছে , বর্ষণ করেছে তরুরাজি
পত্রফুলফল গন্ধরেণু। তাই আজি
কোনোদিন আনমনে বসিয়া একাকী
পদ্মাতীরে, সম্মুখে মেলিয়া মুগ্ধ আঁখি,
সর্ব অঙ্গে সর্ব মনে অনুভব করি -
তোমার মৃত্তিকা-মাঝে কেমনে শিহরি
উঠিতেছে তৃণাঙ্কুর , তোমার অন্তরে
কি জীবনরসধারা অহর্নিশি ধরে
করিতেছে সঞ্চরণ, কুসুমমুকুল
কি অন্ধ অনন্দভরে ফুটিয়া আকুল
সুন্দর বৃন্তের মুখে , নব রৌদ্রালোকে
তরুলতাতৃণগুল্ম কি গূঢ় পুলকে
কেউ মূঢ় প্রমোদরসে উঠে হরষিয়া
মাতৃস্তনপানশ্রান্ত পরিতৃপ্তহিয়া
সুখস্বপ্নহাস্যমুখ শিশুর মতন।
তাই আজি কোনোদিন শরৎকিরণ
পড়ে যবে পক্কশীর্ষ স্বর্ণক্ষেত্র-'পরে ,
নারিকেলদলগুলি কাঁপে বায়ুভরে
আলোকে ঝিকিয়া , জাগে মহাব্যাকুলতা -
মনে পড়ে বুঝি সেই দিবসের কথা
মন জাবে ছিল মোর সর্বব্যাপী হয়ে
জলে স্থলে অরণ্যের পল্লবনিলয়ে
আকাশের নীলিমায়।  ডাকে যেন মোরে
অব্যক্ত আহ্বানরবে শতবারকরে
সমস্ত ভুবন। সে বিচিত্র সে বৃহৎ
খেলাঘর হতে মিশ্রিত মর্মরবৎ
শুনিবারে পাই যেন চিরদিনকার
সঙ্গীদের লক্ষবিধ আনন্দখেলার
পরিচিত রব।  সেথায় ফিরায়ে লহো
মোরে আরবার।  দূর করো সে বিরহ
যে বিরহ থেকে থেকে জেগে উঠে মনে
হেরি যবে সন্মুখেতে সন্ধ্যার কিরণে
বিশাল প্রান্তর, যবে ফায়ার গাভীগুলি
দূর গোষ্ঠে মাঠপথে উড়াইয়া ধূলি,
তরু-ঘেরা গ্রাম হতে উঠে ধূমলেখা
সন্ধ্যাকাশে , যবে চন্দ্র দূরে দেয় দেখা
শ্রান্ত পথিকের মতো অতি ধীরে ধীরে
নদীপ্রান্তে জনশূন্য বালুকার তীরে ;
মনে হয় আপনারে একাকী প্রবাসী
নির্বাসিত , বহু বাড়াইয়া ধেয়ে আসি
সমস্ত বাহিরখানি লইতে অন্তরে -
এ আকাশ, এ ধরণী, এই নদী - 'পরে
শুভ্র শান্ত সুপ্ত জ্যোৎস্নারাশি।  কিছু নাহি
পারি পরশিতে, শুধু শূন্যে থাকি চাহি
বিষাদব্যাকুল।  আমারে ফিরায়ে লহো
সেই সর্ব-মাঝে যেথা হতে অহরহ
অঙ্কুরিছে মুকুলিছে মুঞ্জরিছে প্রাণ
শতেক সহস্র রূপে, গুঞ্জরিছে গান
শতলক্ষ সুরে, উচ্ছসি উঠিছে নৃত্য
অসংখ্য ভঙ্গিতে, প্রবাহি যেতেছে চিত্ত
ভাবস্রোতে , ছিদ্রে ছিদ্রে বাজিতেছে বেণু ;
দাঁড়ায়ে রয়েছ তুমি শ্যাম কল্পধেনু,
তোমারে সহস্র দিকে করিছে দোহন
তরুলতা পশুপক্ষী কত অগণন
তৃষিত পরানী যত ; আনন্দের রস
কত রূপে হতেছে বর্ষণ , দিক দশ
ধ্বনিছে কল্লোলগীতে।  নিখিলের সেই
বিচিত্র আনন্দ যত এক মুহূর্তেই
একত্রে কৰিব আস্বাদন এক হয়ে
সকলের সনে।  আমার আনন্দ লয়ে
হবে না কি শ্যামতর অরণ্য তোমার -
প্রভাত আলোক মাঝে হবে না সঞ্চার
নবীন কিরণকম্প ? মোর মুগ্ধ ভাবে
আকাশধরণীতল আঁকা হয়ে যাবে
হৃদয়ের রঙে - যা দেখে কবির মনে
জাগিবে কবিতা, প্রেমিকের দুনয়নে
লাগিবে ভাবের ঘোর , বিহঙ্গের মুখে
সহসা আসিবে গান।  সহস্রের মুখে
রঞ্জিত হইয়া আছে সর্বাঙ্গ তোমার
হে বসুধে ! প্রাণস্রোত কত বারম্বার
তোমারে মন্ডিত করি আপন জীবনে
গিয়েছে ফিরেছে ; তোমার মৃত্তিকা-সনে
মিশায়েছে অন্তরের প্রেম, গেছে লিখে
কত লেখা , বিছায়েছে কত দিকে দিকে
ব্যাকুল প্রাণের আলিঙ্গন ; তারই সনে
আমার সমস্ত প্রেম মিশায়ে যতনে
তোমার অঞ্চলখানি দিব রাঙাইয়া
সজীব বরণে; আমার সকল দিয়া
সাজাব তোমারে।  নদীজল মোর গান
পাবে নাকি শুনিবারে কোনো মুগ্ধ কান
নদীকূল হতে ? উষালোকে মোর হাসি
পাবে না কি দেখিবারে কোনো মর্তবাসী
নিদ্রা হতে উঠি ? আজ শতবর্ষ -পরে
এ সুন্দর অরণ্যের পল্লবের স্তরে
কাঁপিবে না আমার পরান ? ঘর ঘরে
কতশত নরনারী চিরকাল ধরে
পাতিবে সংসারখেলা , তাহাদের প্রেমে
কিছু কি রব না আমি ? আসিব না নেমে -
তাদের মুখের 'পরে হাসির মতন ,
তাদের সর্বাঙ্গ-মাঝে সরস যৌবন ,
তাদের বসন্ত দিনে অকস্মাৎ সুখ ,
তাদের মনের কোনে নবীন উন্মুখ
প্রেমের অঙ্কুর-রূপে ? ছেড়ে দিবে তুমি
আমারে কি একেবারে ওগো মাতৃভূমি -
যুগ -যুগান্তের মহা মৃত্তিকাবন্ধন
সহসা কি ছিঁড়ে যাবে ? কৰিব গমন
ছাড়ি লক্ষ বরষের স্নিগ্ধ ক্রোড়খানি ?
চতুর্দিক হতে মোরে লবে না কি টানি -
এই-সব তরুলতা গিরি নদী বন ,
এই চিরদিবসের সুনীল গগন ,
এই জীবনপরিপূর্ণ উদার সমীর ,
জাগরণপূর্ণ আলো , সমস্ত প্রাণীর
অন্তরে-অন্তরে গাঁথা জীবনসমাজ ?
ফিরিব তোমারে ঘিরি , করিব বিরাজ
তোমার আত্মীয় মাঝে ; কীট পশু পাখি
তরু গুল্ম লতা-রূপে বারম্বার ডাকি
আমারে লইবে তবে প্রানতপ্ত বুকে ;
যুগে যুগে জন্মে জন্মে স্তন দিয়ে মুখে
মিটাইবে জীবনের শতলক্ষ ক্ষুধা
শতলক্ষ আনন্দের স্তন্যরসসুধা
নিঃশেষে নিবিড় স্নেহে করাইয়া পান।
তার পর ধরিত্রীর যুবক সন্তান
বাহিরিব জগতের মহাদেশ মাঝে
অতি দূর দূরান্তরে জ্যোতিষ্কসমাজে
সুদুর্গম পথে।  এখনো মিটেনি আশা ;
এখনো তোমার স্তন-অমৃত পিপাসা
মুখেতে রয়েছে লাগি; তোমার আনন
এখনো জাগায় চোখে সুন্দর স্বপন ;
এখনো কিছুই তব করি নাই শেষ।
সকলি রহস্যপূর্ণ , নেত্র অনিমেষ
বিস্ময়ের শেষতল খুঁজে নাহি পায় ;
এখনো তোমার বুকে আছি শিশুপ্রায়
মুখপানে চেয়ে।  জননী , লহো গো মোরে ,
সঘনবন্ধন তব বাহুযুগ ধ'রে
আমারে করিয়া লহো তোমার বুকের,
তোমার বিপুল প্রাণ বিচিত্র সুখের
উৎস উঠিতেছে যেথা সে গোপন পুরে
আমারে লইয়া যাও - রাখিয়ো না দূরে।



          নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ


              আজি এ প্রভাতে রবির কর
              কেমনে পশিল প্রাণের 'পর
      কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান !
 না জানি কেনরে এতো দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
                  জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
         ওরে উথলি উঠিছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
                  থর থর করি কাঁপিছে ভূধর
                  শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে
                  ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
                  গরজি উঠিছে দারুন রোষে
                  হেথায় হেথায় পাগলের প্রায়
                  ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় -
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
                  কেন রে বিধাতা পাষান হেন,
                  চারিদিকে তার বাঁধন কেন !
                  ভাঙ রে হৃদয় , ভাঙ রে বাঁধন,
                  সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন
                  লহরির পরে লহরী তুলিয়া
                  আঘাতের 'পরে আঘাত কর।
                  মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
                  কিসের আঁধার কিসের পাষাণ !
                  উথলি যখন উঠেছে বাসনা
                  জগতে তখন কিসের ডর !

                 আমি  ঢালিব করুনাধারা
                 আমি ভাঙিব পাষাণকারা
                 আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব  গাহিয়া
                            আকুল পাগল-পারা
                 কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
                 রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিবো রে পড়ান ঢালি।
                 শিখর হইতে শিখরে ছুটিব
                 ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব ,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।
এত  কথা আছে , এত গান আছে , এত প্রাণ আছে মোর,
এতো সুখ আছে , এতো সাধ আছে - প্রাণ হয়ে আছে ভোর ।।
কি জানি কি হলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ -
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
                  ওরে, চারিদিকে মোর
                  এ কী কারাগার ঘোর -
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা , আঘাতে আঘাত কর।
ওরে আজ           কি গান গেয়েছে পাখি,
                        এসেছে রবির কর ।।





শা -জাহান

এ কথা জানিতে তুমি ভারত - ঈশ্বর শা-জাহান ,
কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধানমান
শুধু তবে অন্তরবেদনা
চিরন্তন হয়ে থাকে সম্রাটের ছিল এ সাধনা
রাজশক্তি বজ্র সুকঠিন
সন্ধারক্তরাগসম তন্দ্রতলে হয় হোক লীন
কেবল একটি দীর্ঘশ্বাস
নিত্য-উচ্ছসিত হয়ে সকরুণ করুক আকাশ ,
এই তব মনে ছিল আশ।
হীরামুক্তামানিক্যের ঘটা
যেন শূন্য দিগন্তের ইন্দ্রজাল ইন্দ্রধনুচ্ছটা
যায় যদি লুপ্ত হয়ে যাক ,
শুধু থাক্
একবিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জল
এ তাজমহল ।।

হায় ওরে মানবহৃদয় ,
বার বার
কারো পানে ফিরে চাহিবার
নাই যে সময়
নাই নাই।
জীবনের খরস্রোতে ভাসিছ সদাই
ভুবনের ঘাটে ঘাটে -
এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য ঘাটে
দক্ষিণের মন্ত্রগুঞ্জরণে
তবে কুঞ্জবনে
বসন্তের মাধবীমঞ্জরি
সেই ক্ষনে দেয় ভরি
মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল -
বিদায়গোধূলি আসে ধুলায় ছড়ায়ে ছিন্ন দল।
সময় যে নাই ,
আবার শিশিররাত্রে তাই
নিকুঞ্জে ফুটায়ে তোল নব কুন্দরাজি
সাজাইতে হেমন্তের অশ্রুভরা আনন্দের সাজি।
হায় রে হৃদয়,
তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
নাই নাই, নাই যে সময় ।।
হে সম্রাট , তাই তব শঙ্কিত হৃদয়
চেয়েছিল করিবারে সময়ের হৃদয়হরণ
সৌন্দর্যে ভুলায়ে।
কণ্ঠে তার কি মালা দুলায়ে
করিলে বরণ
রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে।
রহে না যে
বিলাপের অবকাশ
বারো মাস,
তাই তব অশান্ত ক্রন্দনে
চিরমৌনজাল দিয়ে বেঁধে নিলে কঠিন বন্ধনে।
জ্যোৎস্নারাতে নিভৃত মন্দিরে
প্রেয়সীরে
যে নামে ডাকিতে ধীরে ধীরে
সেই কানে কানে ডাকা রেখে গেলে এইখানে
অনন্তের কানে।
প্রেমের করুণ কোমলতা ,
ফুটিল তা
সৌন্দর্যের পুষ্পপূঞ্জে প্রশান্ত পাষাণে ।।

হে সম্রাট কবি
এই তবে হৃদয়ের ছবি
এই তবে নব মেঘদূত ,
অপূর্ব অদ্ভুত
ছন্দে গানে
উঠিয়াছে অলক্ষের পানে -
যেথা তব বিরহিনী প্রিয়া
রয়েছে মিশিয়া
প্রভাতের অরুন-আভাসে ,
ক্লান্তসন্ধ্যা দিগন্তের করুণ নিঃশ্বাসে ,
পূর্নিমায় দেহহীন চামেলীর লাবণ্যবিলাসে,
ভাষার অতীত তীরে
কাঙাল নয়ন যেথা দ্বার হতে আসে ফিরে ফিরে।
তোমার সৌন্দর্যদূত জুগ যুগ ধরি
এড়াইয়া কালের প্রহরী
চলিয়াছে বাক্যহারা এই বার্তা নিয়া -
'ভুলি নাই, ভুলি নাই , ভুলি নাই প্রিয়া।'

চলে গেছ তুমি আজ,
মহারাজ -
রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে
সিংহাসন গেছে টুটে ,
তব সৈন্যদল
যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল
তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে
উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি-'পরে।
বন্দীরা গাহে না গান
যমুনাকল্লোল-সাথে নহবৎ মিলায় না তান
তব পুরসুন্দরীর নূপুরনিক্কণ
ভগ্ন প্রাসাদের কোণে
ম'রে গিয়ে ঝিল্লিস্বনে
কাদায় রে নিশার গগন
তবুও তোমার দূত অমলিন ,
শ্রান্তিক্লান্তিহীন,
তুচ্ছ করি রাজ্য-ভাঙাগড়া ,
তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া,
যুগে যুগান্তরে
কহিতেছে একস্বরে
চিরবিরহীর বাণী নিয়া
'ভুলি নাই, ভুলি নাই , ভুলি নাই প্রিয়া।'

মিথ্যা কথা ! কে বলে ভোল নাই ?
কে বলে রে খোল নাই
স্মৃতির পিঞ্জরদ্বার ?
অতীতের চির-অস্ত অন্ধকার
আজিও হৃদয় তব রেখেছে বাঁধিয়া ?
বিস্মৃতির মুক্তিপথ দিয়া
আজিও সে হয় নি বাহির ?
সমাধিমন্দির এক ঠাঁই রহে চিরস্থির,
ধরার ধুলায় থাকি
স্মরণের আবরণে মরণেরে যত্নে রাখে ঢাকি।
জীবনেরে কে রাখিতে পারে !
আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।
তার নিমন্ত্রণ লোকে লোকে
নব নব পূর্বাচলে আলোকে আলোকে।
স্মরণের গ্রন্থি টুটে
সে যে যায় ছুটে
বিশ্বপথে বন্ধনবিহীন।
মহারাজ , কোনো মহারাজ কোনোদিন
পারে নাই তোমারে ধরিতে।
সমুদ্রস্তনিত পৃথ্বী , হে বিরাট , তোমারে ভরিতে
নাহি পারে -
তাই এ ধরারে
জীবন-উৎসব-শেষে দুই পায়ে ঠেলে
মৃৎপাত্রের মতো যাও ফেলে।
তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ ,
তাই তব জীবনের রথ
পদচাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।
তাই
চিহ্ন তব পড়ে  আছে , তুমি হেথা নাই।
যে প্রেম সমুখপানে
চলিতে চালাতে নাহি জানে,
যে প্রেম পথের মধ্যে পেতেছিল নিজসিংহাসন ,
তার বিলাসে সম্ভাষণ
পথের ধুলার মতো জড়ায়ে ধরিছে তব পায়ে -
দিয়েছ তা ধূলিরে ফিরায়ে।
সেই তব পশ্চাতের পদধূলি-'পরে
তব চিত্ত হতে বায়ুভরে
কখন সহসা
উড়ে পড়েছিল বীজ জীবনের মাল্য হতে খসা।
তুমি চলে গেছো দূরে ,
সেই বীজ আমার অঙ্কুরে
উঠেছে অম্বর পানে ,
কহিছে গম্ভীর গানে -
'যত দূর চাই
নাই নাই সে পথিক নাই
প্রিয়া তারে রাখিল না , রাজ্য তারে ছেড়ে দিল পথ ,
রুধিল না সমুদ্র পর্বত।
আজি তার রথ চলিয়াছে রাত্রির আহবানে
নক্ষত্রের গানে
প্রভাতের সিংহদ্বার-পানে।
তাই স্মৃতিভারে আমি পরে আছি ,
ভারমুক্ত সে এখানে নাই। '




               প্রার্থনা

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য , উচ্চ যেথা শির ,
জ্ঞান যেথা  মুক্ত , যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছসিয়া উঠে , যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চারিতার্থতায় ,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতোপথ ফেলে নাই গ্রাসি  -
পৌরুষেরে করেনি শতধা, নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা ,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি পিতঃ ,
ভারতের সেই স্বর্গে করো জাগরিত ।।


                 মেঘদূত


কবিবর , কবে কোন বিস্মৃত বরষে
কোন পুন্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত ! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে ।।

সেদিন সে উজ্জয়িনীপ্রাসাদশিখরে
কী  না জানি ঘনঘটা , বিদ্যুৎ-উৎসব ,
উদ্দাম পবনবেগ , গুরুগুরু রব !
গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘসংঘর্ষের
জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের
অন্তরগূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন
এক দিনে।  ছিন্ন করি কালের বন্ধন
সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোকরাশি ।।

সেদিন কি জগতের যতেক প্রবাসী
জোড়হস্তে মেঘপানে শূন্যে তুলি মাথা
গেয়েছিল সমস্বরে বিরহের গাথা
ফিরি প্রিয়গৃহ-পানে ? বন্ধনবিহীন
নবমেঘপক্ষ -' পরে করিয়া আসীন
পাঠাতে চাহিয়াছিল প্রেমের বারতা
অশ্রুবাষ্প-ভরা  - দূর বাতায়নে যথা
বিরোহিণী ছিল শুয়ে ভূতল-শয়নে
মুক্তকেশে, স্নানবেশে, সজলনয়নে ?।
তাদের সবার গান তোমার সংগীতে
পাঠায়ে কি দিলে, কবি, দিবসে নিশীথে
দেশে দেশান্তরে খুঁজি বিরহিনী প্রিয়া ?
শ্রাবনে জাহ্নবী যথা যায় প্রবাহিয়া
টানি লয়ে দিশ -দিশান্তরে বারিধারা
মহাসমুদ্রের মাঝে হতো দিশাহারা।
পাষানশৃঙ্খলে যথা বন্দী হিমাচল
আষাঢ়ে অনন্ত শুন্যে হেরি মেঘদল
স্বাধীন , গগনচারী , কাতরে নিশ্বাসি
সহস্র কন্দর হতে বাস্প রাশি রাশি
পাঠায় গগন-পানে। ধায় তারা ছুটি
উধাও কামনা সম , শিখরেতে উঠি
সকলে মিলিয়া শেষে হয় একাকার ,
সমস্ত গগনতল করে অধিকার ।।

সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস স্নিগ্ধ নববরষার।
প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের 'পরে করি বরিষণ
নববৃষ্টিবারিধারা , করিয়া বিস্তার
নবঘনস্নিগ্ধচ্ছায়া, করিয়া  সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের ,
স্ফীত  করি স্রোতোবেগে তোমার ছন্দের
বর্ষাতরঙ্গিণীসম ।।

           কত কাল ধ'রে
কত সঙ্গীহীন জন প্রিয়াহীন ঘরে
বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী
আষাঢ়সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি
ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ
নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন।
সে-সবার কণ্ঠস্বর করনে আসে মম
সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি-সম
তব কাব্য হতে ।।

           ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আছি সেই শ্যামবঙ্গদেশে
যেথা জয়দেব কবি কোন বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া , পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর ।।

আজি অন্ধকার দিবা , বৃষ্টি ঝরঝর ,
দুরন্ত পবন অতি - আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যতবাহু  করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া ।।

অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পরিতেছি মেঘদূত।  গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন ,
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে।  কোথা আছে
সানুমন আম্রকুট , কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধপদমূলে
উপলব্যথিতগতি, বেত্রবতীকূলে
পরিণতফলশ্যামজম্বুবনচ্ছায়ে
কোথায় দর্শাণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে
প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা,
পথতরুশাখে কোথা গ্রামবিহঙ্গেরা
বর্ষায় বাঁধিছে নীড় কলরবে ঘিরে
বনস্পতি ! না জানি সে কোন নদীতীরে
যুথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে ,
তপ্ত কপোলের তাপে তপ্ত কর্ণৎপল
মেঘের ছায়ার  হতেছে বিকল।
ভ্রুবিলাসে শেখে নাই করা সেই নারী
জনপদবধূজন গগনে নেহারি
ঘনঘটা , উর্দ্ধনেত্রে চাহে মেঘ-পানে ;
ঘননীল ছায়া পড়ে সুনীল নয়ানে !
কোন মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা
স্নিগ্ধ নবঘন দেখি আছিল উন্মনা
শিলাতলে ; সহসা আসিতে মহা ঝড়
চকিত চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড়
সম্বরি বসন ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি ,
বলে, মা গো , গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি !
কোথায় অবন্তিপুরী , নির্বিন্ধ্যা তটিনী ,
কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী
স্বমহিমাচ্ছায়া ! সেথা নিশি দ্বিপ্রহরে
প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে
সুপ্ত পারাবত ; শুধু বিরহবিকারে
রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে
সূচীভেদ্য অন্ধকারে রাজপথমাঝে
ক্কচ্চিৎবিদ্যুৎলোকে।  কথা সে বিরাজে
ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র ! কথা কনখল ,
যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল
গৌরির ভ্রুকুটিভঙ্গি করি অবহেলা
ফেনপরিহাসচ্ছলে  করিতেছে খেলা
লয়ে ধুর্জটির জটা চন্দ্রকরজ্জ্বল ।।
এইমতো মেঘরূপে ফিরি দেশে দেশে
হৃদয় ভাসিয়া চলে উত্তরিতে শেষে
কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে ,
বিরহিনী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে
সৌন্দর্যের আদিসৃষ্টি।  সেথা কে পারিত
লয়ে যেতে তুমি ছাড়া করি অবারিত
লক্ষীর বিলাসপুরী - ভুবনে !
অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে
নিত্য চন্দ্রালোকে , ইন্দ্রনীল শৈলমূলে
সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকুলে ,
মনিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা।
 মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা -
শয্যাপ্রান্তে লীণতনু ক্ষীণশশীরেখা
পূর্বগগনের মুলে যেন অস্তপ্রায়।
কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায়
রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যাথা।
লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক , যেথা
চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিনী প্রিয়া
অনন্তসৌন্দর্য-মাঝে একাকী জাগিয়া ।।

আবার হারায়ে যায়; হেরি, চারি ধার
বৃষ্টি পরে অবিশ্রাম।  ঘনায়ে আঁধার
আসিছে নির্জন নিশা।  প্রান্তরের শেষে
কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকূল -উদ্দেশে।
ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রানয়ান -
কে দিয়েছে হেন শাপ , কেন ব্যবধান ?
কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পে পথ ?
সশরীরে কোন নর গেছে সেইখানে ,
মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে ,
রবিহীন মণিদ্বীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে !



                   মানসী 

শুধু বিধাতার সৃষ্টি নহ তুমি নারী
পুরুষ গড়েছে তোরে সৌন্দর্য সঞ্চারী
আপন অন্তর হতে।  বসি কবিগণ
সোনার উপমাসূত্রে বুনেছে বসন।
সপিয়া তোমার 'পরে নুতন মহিমা
অমর করেছে শিল্পী তোমার প্রতিমা ।
কত বর্ণ, কত গন্ধ , ভূষণ কত-না  -
সিন্ধু হতে মুক্তা আসে , খনি হতে সোনা ,
বসন্তের বন হতে আসে পুষ্পভার ,
চরণ রাঙাতে কীট দেয় প্রাণ তার।
লজ্জা দিয়ে, সজ্জা দিয়ে, দিয়ে আবরণ ,
তোমারে দুর্লভ করি করেছে গোপন ।
পড়েছে তোমার পরে প্রদীপ্ত বাসনা -
অর্ধেক মানবী তুমি , অর্ধেক কল্পনা ।।


                  ভারততীর্থ

হে মোর চিত্ত, পুন্য তীর্থে জাগো রে ধীরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে  দু বাহু বাড়ায়ে নমি নর দেবতারে
উদার ছন্দে পরমানন্দে বন্দন করি তারে
ধ্যানগম্ভীর এই যে ভূধর , নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হেরো পবিত্র ধরিত্রীর
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।

কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন -
শাক-হুন-দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন।
পশ্চিমে আজি খুলিয়াছে দ্বার, সেথা হতে সবে আনে উপহার ,
দিবে আর নিবে মিলবে মিলিবে যাবে না ফিরে -
এই ভারতের মহামানবের সাগর তীরে ।।

রণাধারা বাহি জয়গান গাহি উন্মাদকলরবে
ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিলো সবে
তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে কেহ নহে নহে দূর -
আমার শোনিতে রয়েছে ধ্বনিতে তার বিচিত্র সুর।
হে রুদ্রবীণা , বাজো বাজো , বাজো ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজও
বন্ধ নাশিবে - তারাও আসিবে দাঁড়াবে ঘিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।

হেথা একদিন বিরাম বিহীন মহা-ওঙ্কারধ্বনি
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে উঠেছিল রণরণি।
তপস্যাবলে একের অনলে বহরে আহুতি দিয়া
বিভেদ ভুলিল , জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।
সেই সাধনার সে আরাধনার  যজ্ঞশালার খোলা আজি দ্বার
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে আনত শিরে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।

সেই হোমানলে হেরো আজি জ্বলে দুঃখের রক্তশিখা -
হবে তা সহিতে , মর্মে দহিতে আছে সে ভাগ্যে লিখা।
এ দুঃখবহন করো মোর মন, শোন রে একের ডাক -
যত লাজ ভয় করো করো জয়, অপমান দূরে যাক।
দুঃসহ ব্যাথা হয়ে অবসান জন্ম লভিবে কি বিশাল প্রাণ
পোহায় রজনী , জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।

এসো হে আর্য , এসো অনার্য , হিন্দু মুসলমান -
এসো এসো আজ তুমি ইংরাজ , এসো এসো খ্রিস্টান।
এস ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার।
এস হে পতিত, হোক অপনীত সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা , মঙ্গলঘট হয় নি যে ভরা
সবার-পরশে-পবিত্র-করা তীর্থনীরে -
এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে ।।



ওরা কাজ করে

অলস সময়ধারা বেয়ে
মন চলে শূন্যপানে চেয়ে।
সে মহাশূন্যের পথে ছায়া আঁকা ছবি পরে চোখে।
কত কাল দলে দলে গেছে কত লোকে
সুদীর্ঘ অতীতে
জয়োদ্ধত প্রবল গতিতে
এসেছে সাম্রাজ্যলোভী পাঠানের দল ,
এসেছে মোগল ;
বিজয়রথের চাকা
উড়ায়েছে ধুলিজাল, উড়িয়াছে বিজয়পতাকা।
শূন্যপথে চাই ,
আজ তার কোনো চিহ্ন নাই।
নির্মল সে নীলিমায় প্রভাতে ও সন্ধ্যায় রাঙালো
যুগে যুগে সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আলো।
আরবার সেই শূন্যতলে
আসিয়াছে দলে দলে
লৌহবাঁধা পথে
অনলনিশ্বাসী রথে
প্রবল ইংরেজ ;
বিকীর্ণ করেছে তার তেজ।
জানি তারও পথ দিয়ে বয়ে যাবে কাল,
কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশ-বেড়া জাল ।
জানি তার পণ্যবাহী সেনা
জ্যোতিষ্কলোকের পথে রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না ।।
মাটির পৃথিবী পানে আঁখি মেলি যবে
দেখি সেথা কলকলরবে
বিপুল জনতা চলে
নানা পথে নানা দলে দলে
যুগ যুগান্তর হতে মানুষের নিত্য প্রয়োজনে
জীবনে মরণে।
ওরা চিরকাল
টানে দাঁড় , ধরে থাকে হাল ;
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে , পাকা ধান কাটে -
ওর কাজ করে
নগরে প্রান্তরে।
রাজছত্র ভেঙে পড়ে ; রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে ;
জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে ;
রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।
ওরা  কাজ করে
দেশে দেশান্তরে
অঙ্গ বংগ কলিঙ্গের সমুদ্র-নদীর ঘাটে ঘাটে ,
পঞ্জাবে বোম্বাই-গুজরাটে।
গুরু গুরু গর্জন - গুন্ গুন্ স্বর -
দিন রাত্রে গাঁথা পড়ি দিনযাত্রা করিছে মুখর।
দুঃখ সুখ দিবসরজনী
মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।
শত শত সাম্রাজ্যের ভগ্নশেষ-'পরে
ওরা কাজ করে ।।


















No comments:

Post a Comment