হারিয়ে যাওয়া
ছোট্ট আমার মেয়ে
সঙ্গিনীদের ডাক শুনতে পেয়ে
সিঁড়ি দিয়ে নিচের তলায় যাচ্ছিল সে নেমে
অন্ধকারে ভয়ে ভয়ে , থেমে থেমে।
হাতে ছিল প্রদীপখানি ,
আঁচল দিয়ে আড়াল ক'রে চলছিল সাবধানী ।।
আমি ছিলাম ছাতে
তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে।
হঠাৎ মেয়ের কান্না শুনে, উঠে
দেখতে গেলাম ছুটে।
সিঁড়ির মধ্যে যেতে যেতে
প্রদীপটা তার নিভে গেছে বাতাসেতে ।
শুধাই তারে 'কি হয়েছে বামি ? '
সে কেঁদে কয় নিচে থেকে , 'হারিয়ে গেছি আমি। '
তারায় ভরা চৈত্র মাসের রাতে
ফিরে গিয়ে ছাতে
মনে হল আকাশ-পানে চেয়ে ,
আমার বামীর মতোই যেন অমনি কে এক মেয়ে
নীলাম্বরের আঁচলখানি ঘিরে
দীপশিখাটি বাঁচিয়ে এক চলছে ধীরে ধীরে।
নিবত যদি আলো, যদি হঠাৎ যেত থামি,
আকাশ ভোরে উঠত কেঁদে 'হারিয়ে গেছি আমি !'
ঠাকুরদাদার ছুটি
তোমার ছুটি নীল আকাশে , তোমার ছুটি মাঠে,
তোমার ছুটি থইহারা ওই দীঘির ঘাটে ঘাটে।
তোমার ছুটি তেঁতুল-তলায়, গোলাবাড়ির কোণে ,
তোমার ছুটি ঝোপেঝাপে পারুলডাঙার বনে।
তোমার ছুটির আশা কাঁপে কাঁচা ধানের ক্ষেতে ,
তোমার ছুটির খুশি নাচে নদীর তরঙ্গেতে ।।
আমি তোমার চশমা-পরা বুড়ো ঠাকুরদাদা,
বিষয়-কাজের মাকড়সাটার বিষম জালে বাঁধা।
আমার ছুটি সেজে বেড়ায় তোমার ছুটির সাজে।
তোমার কন্ঠে আমার ছুটির মধুর বাঁশি বাজে।
আমার ছুটি তোমারই ওই কাপল চোখের নাচে,
তোমার ছুটির মাঝখানেতেই আমার ছুটি আছে ।।
তোমার ছুটির খেয়া বেয়ে শরৎ এল মাঝি ,
শিউলিকানন সাজায় তোমার শুভ্র ছুটির সাজি।
শিশির হাওয়া শিরশিরিয়ে কখন রাতারাতি
হিমালয়ের থেকে আসে তোমার ছুটির সাথী
অশ্বিনের এই আলো এল ফুল-ফোটানো ভোরে
তোমার ছুটির রঙে রঙিন চাদরখানি প'রে ।।
আমার ঘরে ছুটির বন্যা তোমার লাফে-ঝাঁপে ,
কাজকর্ম হিসাবকিতাপ থরথরিয়ে কাঁপে।
গলা আমার জড়িয়ে ধর, ঝাঁপিয়ে পড় কোলে -
সেই তো আমার অসীম ছুটি প্রাণের তুফান তোলে।
তোমার ছুটি কে যে জোগায় জানি না তার রীত-
আমার ছুটি জোগাও তুমি , ওইখানে মোর জিত ।।
মনে-পড়া
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু কখন খেলতে গিয়ে হঠাৎ অকারণে
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কানে আমার বাজে ,
মায়ের কথা মিলে যেন আমার খেলার মাঝে।
মা বুঝি গান গাইত আমার দোলনা ঠেলে ঠেলে -
মা গিয়েছে, যেতে যেতে গানটি গেছে ফেলে ।।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন অশ্বিনেতে নহরে শিউলিবনে
শিশির ভেজা হাওয়া বেয়ে ফুলের গন্ধ আসে
তখন কেন মায়ের কথা আমার মনে ভাসে।
কবে বুঝি আনত মা সেই ফুলের সাজি বয়ে -
পুজোর গন্ধ আসে যে তাই মায়ের গন্ধ হয়ে ।।
মাকে আমার পড়ে না মনে।
শুধু যখন বসি গিয়ে সবার ঘরের কোণে।,
জানলা থেকে তাকাই দূরে নীল আকাশের দিকে -
মনে হয় মা আমার পানে চাইছে অনিমিখে।
কোলের প'রে ধ'রে কবে দেখতো আমায় চেয়ে ,
সেই ছাউনি রেখে গেছে সারা আকাশ ছেয়ে ।।
৯ আশ্বিন ১৩২৮
খেলাভোলা
তুই কি ভাবিস দিনরাত্তির খেলতে আমার মন ?
কক্ষনো তা সত্যি না মা, আমার কথা শোন।
সেদিন ভোরে উঠে দেখি বৃষ্টিবাদল গেছে ছুটে।,
রোদ উঠেছে ঝিলমিলিয়ে বাঁশের ডালে ডালে।
ছুটির দিনে কেমন সুরে পুজোর সানাই বাজছে দূরে ,
তিনটে শালিক ঝগড়া করে রান্নাঘরের চালে
খেলনাগুলো সামনে মেলি কি-যে খেলি, কি-যে খেলি ,
সেই কথাটাই সমস্তখন ভাবনু আপন মনে।
লাগল না ঠিক কোন খেলাই , কেটে গেল সারা বেলাই -
রেলিং ধরে রইনু বসে বারান্দাটার কোণে ।।
খেলা ভোলার দিন , মা, আমার আসে মাঝে মাঝে -
সেদিন আমার মনের ভিতর কেমনতরো বাজে।
শীতের বেলায় দুই পহরে দূরে কাদের ছাদের 'পরে
ছোট্ট মেয়ে রোদ্দুরে দে বেগনি রঙের শাড়ি।
চেয়ে চেয়ে চুপ করে রই তেপান্তরের পার বুঝি ওই -
মানে ভাবি ঐখানেতেই আছে রাজার বাড়ি।
থাকত যদি মেঘে-ওড়া পক্ষিরাজের বাচ্চা ঘোড়া,
তক্ষুনি যে যেতেম টরে লাগাম দিয়ে ক'ষে।
যেতে যেতে নদীর তীরে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমীরে
পথ শুধিয়ে নিতাম আমি গাছের তলায় বসে ।।
এক-একদিন যে দেখেছি তুই বাবার চিঠি হাতে
চুপ করে কি ভাবিস বসে ঠেস দিয়ে জানলাতে।
মনে হয় তোর মুখে চেয়ে তুই যেন কোন দেশের মেয়ে,
যেন আমার অনেক কাছের অনেক দূরের মা।
কাছে গিয়ে হাতখানি ছুঁই - হারিয়ে-ফেলা মা যেন তুই ,
মাঠ -পারে কোন বটের তলার বাঁশির সুরের মা।
খেলার কথা যায় যে ভেসে, মনে ভাব কোন কালে সে
কোন দেশে তোর বাড়ি ছিল কোন সাগরের কূলে !
ফিরে যেতে ইচ্ছে করে অজানা সেই দ্বীপের ঘরে
তোমায় আমায় ভোরবেলাতে নৌকাতে পাল তুলে ।।
১১ আশ্বিন ১৩২৮
ইছামতী
যখন যেমন মনে করি তাই হতে পাই যদি ,
আমি তবে এক্ষনি হই ইচ্ছামতী নদী।
রাইবে আমার দক্ষিণ ধারে সূর্য-ওঠার পার।,
বাঁয়ের ধারে সন্ধেবেলায় নামবে অন্ধকার ,
আমি কইব মনের কথা দুই পারেরই সাথে -
আধেক কথা দিনের বেলায় , আধেক কথা রাতে ।।
যখন ঘুরে ঘুরে বেড়াই আপন গাঁয়ের ঘাটে
ঠিক তখনি গান গেয়ে যাই দূরের মাঠে মাঠে।
গাঁয়ের মানুষ চিনি - যারা নাইতে আসে জলে ,
গোরু মহিষ নিয়ে যারা সাঁৎরে ও পার চলে।
দূরের মানুষ যারা তাদের নতুন তার বেশ -
নাম জানি নে, গ্রাম জানি নে , অদ্ভুতের এক-শেষ ।।
জলের উপর ঝলোমলো টুকরো আলোর রাশি -
ঢেউয়ে ঢেউয়ে পরীর নাচন, হাততালি আর হাসি।
নীচের তলায় তলিয়ে যেথায় গেছে ঘাটের ধাপ
সেইখানেতে করা সবাই রয়েছে চুপ চাপ।
কোণে কোণে আপন-মনে করছে তারা কী কে ,
আমারই ভয় করবে কেমন তাকাতে সেই দিকে ।।
গাঁয়ের লোকে কিনবে আমার কেবল একটুখানি,
বাকি কোথায় হারিয়ে যাবে আমিই সে কি জানি।
এক ধারেতে মাঠে ঘাটে সবুজ বোরন শুধু ,
আর এক ধারে বালুর চরে রৌদ্র করে ধূ ধূ।
দিনের বেলায় যাওয়া আসা , রাত্তিরে থম থম -
ডাঙ্গার পানে চেয়ে চেযে করবে গা ছম-ছম ।।
২৩ আশ্বিন ১৩২৮
তালগাছ
তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে
সব গাছ ছাড়িয়ে
উঁকি মারে আকাশে।
মনে সাধ কালো মেঘ ফুঁড়ে যায়,
একেবারে উড়ে যায় -
কোথা পাবে পাখা সে ।।
তাই তো সে ঠিক তার মাথাতে
গোল গোল পাতাতে
ইচ্ছাটি মেলে তার
মনে মনে ভাবে বুঝি ডানা এই ,
উড়ে যেতে মণ নেই
বাসাখানি ফেলে তার ।।
সারাদিন ঝরঝর থত্থর
কাঁপে পাতাপত্তর
ওড়ে যেন ভাবে ও -
মনে মনে আকাশেতে বেড়িয়ে
তারাদের এড়িয়ে
যেন কোথা যাবে ও ।।
তার পরে হাওয়া যেই নেমে যায়,
পাতা-কাঁপা থেমে যায়,
ফেরে তার মনটি --
সেই ভাবে মা যে হয় মাটি তার ,
ভালো লাগে আরবার পৃথিবীর কোণটি ।।
২ কার্তিক ১৩২৮
No comments:
Post a Comment