Sonar tori - Poem collection - By Rabindranath Tagore সোনার তরী

            সোনার তরী 

গগনে গরজে মেঘ, ঘন বরষা ।
কূলে একা বসে আছি নাহি ভরসা ।
রাশি রাশি ভারা ভারা           ধান কাটা হলো সারা,
ভরা নদী খুরধারা        খরপরশা ¬
কাটিতে কাটিতে ধান এল বরষা ।।

একখানি ছোটো খেত , আমি একেলা ¬
চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা ।।
পরপারে দেখি আঁকা               তরুছায়ামসী -মাখা
গ্রামখানি মেঘে ঢাকা          প্রভাতবেলা ।
এ পারেতে ছোটো খেত , আমি একেলা ।।

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে !
দেখে যেন মনে হয়, চিনি উহারে ।
ভরা পালে চলে যায়,      কোনো দিকে নাহি চায়
ঢেউগুলি নিরুপায় ভাঙে দুধারে ¬
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে ।।

ওগো, তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে ?
বারেক ভিড়াও তরী , কূলেতে এসে ।
যেয়ো যেথা যেতে চাও , যারে খুশি তারে দাও ¬
শুধু তুমি নিয়ে যাও   ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে ।।

যত চাও তত লও তরণী- 'পরে  ।
আর আছে? আর নাই , দিয়েছি ভরে ।
এতকাল নদীকূলে              যাহালয়ে ছিনু ভুলে
সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে ¬
এখন আমারে লহো করুণা ক'রে ।।

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই , ছোট সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি ।
শ্রাবন গগন ঘিরে     ঘন মেঘ ঘুরে ফিরে ,
শূন্য নদীর তীরে রহিনু পড়ি ¬
যাহা ছিল লয়ে গেল সোনার তরী ।।


[বোট । শিলাইদহ । ফাল্গুন ১২৯৮]



              নিদ্রিতা 

একদা রাতে নবীন যৌবনে
                স্বপ্ন হতে উঠি চমকিয়া ,
বাহিরে এসে দাঁড়ানু একবার ¬
                ধরার পানে দেখিনু নিরখিয়া ।
শীর্ণ হয়ে এসেছে শুকতারা ,
                পূর্বতটে হতেছে নিশিভোর ।
আকাশকোণে বিকাশে জাগরণ ,
                ধরণীতলে ভাঙে নি ঘুমঘোর ।
সমুখে প'ড়ে দীর্ঘ রাজপথ ,
                দু ধারে তারি দাঁড়ায়ে তরুসার ,
নয়নমেলি সুদূর-পানে চেয়ে
                আপন মনে ভাবিনি একবার ¬
অরুণ-রাঙা আজি এ নিশিশেষে
                ধরার মাঝে নুতন কোন দেশে
দুগ্ধফেনশয়ন করি আলো
                স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা  ।।


অশ্ব চড়ে তখনি বাহিরিনু,
               কত যে দেশ বিদেশ হনু পার !
একদা এক ধূসরসন্ধায়
               ঘুমের দেশে লভিনু পুরদ্বার ।
সবাই সেথা অচল অচেতন ,
              কোথাও জেগে নেইকো জনপ্রাণী ,
নদীর তীরে জলের কলতানে
              ঘুমায়ে আছে বিপুল পুরীখানি ।
ফেলিতে পদ সাহস নাহি মানি ,
              নিমেষে পাছে সকল দেশ জাগে ।
প্রাসাদ-মাঝে পশিনু সাবধানে ,
              শঙ্কা মোর চলিল আগে আগে ।
ঘুমায় রাজা , ঘুমায় রাণীমাতা ,
             কুমার-সাথে ঘুমায় রাজভ্রাতা ।
একটি ঘরে রত্নদ্বীপ জ্বালা ,
              ঘুমায়ে সেথা রয়েছে রাজবালা ।।

কমলফুলবিমল শেজখানি ,
              নিলীন তাহে কোমল তনুলতা ।
মুখের পানে চাহিনু অনিমেষে,
             বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যাথা ।
মেঘের মতো গুচ্ছ কেশোরাশি
             শিথান ঢাকি পড়েছে ভারে ভারে ।
একটি বাহু বক্ষ- 'পরে  পড়ি ,
             একটি বাহু লুটায় একধারে ।
আঁচল খানি পড়েছে খসি পাশে ,
             কাঁচলখানি পড়িবে বুঝি টুটি ¬
পত্রপুটে রয়েছে যেন ঢাকা
             অনাঘ্রাত পূজার ফুল দুটি ।
দেখিনু তারে , উপমা নাহি জানি ¬
             ঘুমের দেশে স্বপন একখানি ,
পালঙ্কেতে মগন রাজবালা
             আপন ভরা লাবণ্যে নিরালা ।।

ব্যাকুল বুকে চাপিনু দুই বাহু
           না মানে বাধা হৃদয়কম্পন ।
ভূতলে বসি আনত করি শির
           মুদিত আঁখি করিনু চুম্বন ।
পাতার ফাঁকে আঁখির তারা দুটি ,
           তাহারি পানে চাহিনু একমনে ¬
দ্বারের ফাঁকে দেখিতে চাহি যেন
           কি আছে কোথা নিভৃত নিকেতনে ।
ভূর্জপাতে কাজলমসী দিয়া
          লিখিয়া দিনু আপন নামধাম ।
লিখিনু, 'অয়ি নিদ্রিতমগনা,
           আমার প্রাণ তোমারে সঁপিলাম ।'
যত্ন করি কনক সুতে গাঁথি
          রতন-হারে বাঁধিয়া দিনু পাঁতি ¬
ঘুমের দেশে ঘুমায় রাজবালা ,
          তাহারি গলে পর্যায়ে দিনু মালা ।।


[শান্তিনিকেতন । ১৪ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯ ]



                 সুপ্তোত্থিতা 

ঘুমের দেশে ভাঙিল ঘুম, উঠিল কলস্বর ।
গাছের শাখে জাগিল পাখি, কুসুমে মধুকর ।
অশ্বশালে জাগিল ঘোড়া, হস্তীশালে হাতি ।
মল্লশালে মল্ল জাগি ফুলায় পুনঃ ছাতি ।
জাগিল পথে প্রহরীদল , দুয়ারে জাগে দ্বারী ,
আকাশ চেয়ে নিরখে বেলা জাগিয়া নরনারী ।
উঠিল জাগি রাজাধিরাজ, জাগিল রাণীমাতা ।
কচালি আঁখি কুমার-সাথে জাগিল রাজভ্রাতা ।
নিভৃত ঘরে ধূপের বাস, রতন-দ্বীপ জ্বালা ,
জাগিয়া উঠি শয্যাতলে শুধালো রাজবালা ¬
                                'কে পরালে মালা !'

খসিয়া-পড়া আঁচলখানি বক্ষে তুলি নিল ।
আপন-পানে নেহারি চেয়ে শরমে শিহরিল ।
ত্রস্ত হয়ে চলিত চোখে চাহিল চারি দিকে ¬
বিজ্ঞ গৃহ, রতন-দ্বীপ জ্বলিছে অনিমিখে ।
গলার মালা খুলিয়া লয়ে ধরিয়া দুটি করে
সোনার সুতে যতনে গাঁথা লিখনখানি পড়ে ।
পড়িল নাম, পড়িল ধাম, পড়িল লিপি তার,
কোলের 'পরে বিছায়ে দিয়ে পড়িল শতবার ।
শয়নশেষে রহিল বসে, ভাবিল রাজবালা ¬
'আপন ঘরে ঘুমায়ে ছিনু নিতান্ত নিরালা,
                             'কে পড়ালে মালা !'

নূতন -জাগা কুঞ্জবনে কুহরি উঠে পিক ,
বসন্তের চুম্বনেতে বিবশ দশদিক ।
বাতাস ঘরে প্রবেশ করে ব্যাকুল উচ্ছাসে ,
নবীনফুলমঞ্জরীর গন্ধ লয়ে আসে ।
জাগিয়া উঠি বৈতালিক গাহিছে জয়গান।,
প্রাসাদদ্বারে ললিত স্বরে বাঁশিতে উঠে তান ।
শীতলছায়া নদীর পথে কলসে লয়ে বারি ¬
কাঁকন বাজে, নূপুর বাজে , চলিছে পুরনারী ।
কাঁকনপথে মর্মরিয়া কাঁপিছে গাছপালা ,
আধেক মুদি নয়নদুটি ভাবিছে রাজবালা ¬
                               'কে পরালে  মালা !'

বারেক মালা গলায় পরে, বারেক লহে খুলি ¬
দুইটি করে চাপিয়া ধরে বুকের কাছে তুলি ।
শয়ন- 'পরে মেলায়ে দিয়ে তৃষিত চেয়ে রয়,
এমনি করে পাইবে যেন অধিক পরিচয় ।
জগতে আজ কত না ধ্বনি উঠিছে কত ছলে ¬
একটি আছে গোপন কথা, সে কেহ না বলে ।
বাতাস শুধু কানের কাছে বহিয়া যায় হূহু ;
কোকিল শুধু অবিশ্রাম ডাকিছে কুহু কুহু
নিভৃত ঘরে পরান মন একান্ত উতলা ,
শয়নশেষে নীরবে বসে ভাবিছে রাজবালা ¬
                              'কে পরালে মালা !'

কেমন বীর-মূর্তি তার মাধুরী দিয়ে মিশা ¬
দীপ্তিভরা নয়ন-মাঝে তৃপ্তিহীন তৃষা ।
স্বপ্নে তারে দেখেছে যেন এমনি মনে লয় ¬
ভুলিয়া গেছে, রয়েছে শুধু অসীম বিস্ময় ।
পার্শ্বে যেন বসিয়াছিল, ধরিয়াছিল কর ,
এখনো তার পরশে যেন সরস কলেবর ।
চমকি মুখ দুহাতে ঢাকে, শরমে টুটে মন,
লজ্জাহীন প্রদীপ কেন নিভেনি সেইক্ষণ !
কণ্ঠ হতে ফেলিল হার যেন বিজুলি জ্বালা,
শয়ন-'পরে লুটায়ে পরে ভাবিল রাজবালা ¬
                              'কে পরালে মালা !'

এমনি ধীরে একটি করে কাটিছে দিন রাতি ।
বসন্ত সে বিদায় নিল লইয়া যূথীজাতি ।
সঘন মেঘে বরষা আসে, বরষে ঝরঝর ,
কাননে ফুটে নবমালতী কদম্বকেশর ।
স্বচ্ছহাসি শরৎ আসে পূর্ণিমামালিকা,
সকল বন আকুল করে শুভ্র শেফালিকা ।
আসিল শীত সঙ্গে লয়ে দীর্ঘ দুখনিশা ,
শিশির-ঝরা কুন্দফুলে হাসিয়া কাঁদে দিশা ।
ফাগুন মাস আবার এলো বহিয়া ফুলডালা ,
জানালা পাশে একেলা বসে ভাবিছে রাজবালা ¬
                                  'কে পরালে মালা !'

[শান্তিনিকেতন , ১৫ জ্যৈষ্ঠ , ১২৯৯ ]



           হিং টিং ছ্ট
              স্বপ্নমঙ্গল


স্বপ্ন দেখেছেন রাত্রে হবুচন্দ্র ভূপ  ¬
অর্থ তার ভেবে ভেবে গবুচন্দ্র চুপ
শিয়রে বসিয়া যেন তিনটি বাঁদরে
উকুন বাছিতেছিল পরম আদরে ¬
একটু নড়িতে গেলে গালে মারে চড় ,
চোখে মুখে লাগে তার নখের আঁচড় ।
সহসা মিলালো তারা আসে বেদে ,
'পাখি উড়ে গেছে' বলে মরে কেঁদে কেঁদে  ।
সম্মুখে রাজারে দেখি তুলি নিল ঘাড়ে ,
ঝুলায়ে বসায়ে দিল উচ্চ এক দাঁড়ে ।
নীচেতে দাঁড়ায়ে এক বুড়ি থুড়থুড়ি
হাসিয়া পায়ের তলে দেয় সুড়সুড়ি ।
রাজা বলে 'কি আপদ '  কেহ নাহি ছাড়ে ¬
পা দুটা তুলিতে চাহে, তুলিতে না পারে ।
পাখির মতন রাজা করে ছটফট
বেদে কানে কানে বলে ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

হবুপুর রাজ্যে আজ দিন ছয়-সাত
চোখে কারো নিদ্রা নাই মুখে নাই ভাত ।
শীর্ণ গালে  হাত দিয়া নত  করি শির
রাজ্যসুদ্ধ বালবৃদ্ধ ভেবেই অস্থির ।
ছেলেরা ভুলেছে খেলা পন্ডিতেরা পাঠ ,
মেয়েরা করেছে চুপ এটি বিভ্রাট ।
সারি সারি বসে গেছে কথা নাহি মুখে ,
চিন্তা যত ভারী হয় মাথা পরে ঝুঁকে ।
ভুঁইফোড় তত্ত্ব যেন ভূমিতলে খোঁজে,
সবে যেন বসে গেছে নিরাকার ভোজে ।
মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছাড়িয়া উৎকট
হঠাৎ ফুকারি উঠে ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।
চারিদিক থেকে এল পন্ডিতের দল ¬


চারিদিক হতে এল পন্ডিতের দল ¬
অযোধ্যা কনোজ কাঞ্চী মগধ কোশল ।
উজ্জয়িনী হতে এল বুধ-অবতংস
কালিদাস কবীন্দ্রের ভাগিনেয়বংশ ।
মোটা মোটা পুঁথি লয়ে উলটায় পাতা ,
ঘন ঘন নাড়ে বসে টিকিসুদ্ধ মাথা ।
বড়ো বড়ো মস্তকের পাকা শস্যক্ষেত
বাতাসে দুলিছে যেন শীর্ষ সমেত ।
কেহ শ্রুতি, কেহ স্মৃতি , কেহ বা পুরাণ ,
কেহ ব্যাকরণ দেখে , কেহ অভিধান ।
কোনোখানে নাহি পায় অর্থ কোনোরূপ ,
বেড়ে উঠে অনুস্বর বিসর্গের স্তুপ ।
চুপ করে বসে থাকে বিষম সংকট ,
থেকে থেকে হেকে উঠে - হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

কহিলেন হতাশ্বাস হবুচন্দ্ররাজ ,
'ম্লেচ্ছদেশে আছে নাকি পন্ডিতসমাজ ¬
তাহাদের ডেকে আনো যে যেখানে আছে ,
অর্থ যদি ধরা পড়ে তাহাদের কাছে ।'
কটা-চুল নীলচক্ষু কপিশকপোল
যবনপন্ডিত আসে , বাজে ঢাক ঢোল ।
গায়ে কালো মোটা মোটা ছাঁটাছোটা কুর্তি ¬
গ্রীষ্মতাপে উষ্মা বাড়ে , ভারী উগ্রমূর্তি ।
ভূমিকা না করি কিছু ঘড়ি খুলি কয় ,
'সতেরো মিনিট মাত্র রয়েছে সময় ¬
কথা যদি থাকে কিছু বলো চটপট ।'
সভাসুদ্ধ বলি উঠে ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।


স্বপ্ন শুনি ম্লেচ্ছমুখ রাঙা টকটকে ,
আগুন ছুটিতে চায় মুখে আর চোখে ।
হানিয়া দক্ষহীন মুষ্টি বাম করতলে
'ডেকে এনে পরিহাস ' রেগেমেগে বলে ।
ফরাসি পন্ডিত ছিল , হাস্যোজ্জ্বল মুখে
কহিল নোয়ায়ে মাথা হস্ত রাখি বুকে ,
'স্বপ্ন যাহা শুনিলাম রাজযোগ্য বটে ,
হেনো  স্বপ্ন সকলের অদৃষ্টে না ঘটে !
কিন্তু তবু স্বপ্ন ওটা করি অনুমান ,
যদিও রাজার শিরে পেয়েছিল স্থান ।
অর্থ চাই? রাজকোষে আছে ভুরি ভুরি ¬
রাজস্বপ্নে অর্থ নাই যত মাথা খুঁড়ি ।
নাই অর্থ , কিন্তু তবু কহি অকপট
শুনিতে কি মিষ্ট আহা ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।


শুনিয়া সভাস্থ সবে করে ধিক-ধিক ,
কোথাকার গন্ডমুর্খ পাষণ্ড নাস্তিক !
স্বপ্ন শুধু স্বপ্নমাত্র মস্তিস্কবিকার
এ কথা কেমন করি করিব স্বীকার !
জগৎ বিখ্যাত মোরা 'ধর্মপ্রাণ' জাতি ¬
স্বপ্ন উড়াইয়া দিবে ! দুপুরে ডাকাতি !
হবুচন্দ্র রাজা কহে পাকালিয়া চোখ ,
'গবুচন্দ্র এদের উচিত শিক্ষা হোক ।
হেঁটোয় কণ্টক দাও, উপরে কণ্টক,
ডালকুত্তাদেরমাঝে করহ বন্টক ।'
সতেরো মিনিট-কাল না হইতে শেষ
ম্লেচ্ছ পন্ডিতের  না মিলে উদ্দেশ ।
সভাস্থ সবাই ভাসে অনন্দ্রাশ্রুনীরে,
ধররাজ্যে পুনর্বার শান্তি এলো ফিরে ।
পন্ডিতেরা মুখ চক্ষু করিয়া বিকট
পুনর্বার উচ্চারিল হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

অতঃপর গৌড় হতে এল হেনো বেলা
যবন পন্ডিতদের গুরু মারা চেলা ।
নগ্নশির , সজ্জা নাই , লজ্জা নাই ধড়ে ¬
কাছা কোঁচা শতবার খসে খসে পড়ে ।
অস্তিত্ব আছে না আছে, ক্ষীণ খর্ব দেহ ,
বাক্য যবে বহিরায় না থাকে সন্দেহ ।
এতটুকু যন্ত্র হতে এতো শব্দ হয়
দেখিয়া বিশ্বের লাগে বিষম বিস্ময় ।
না জানে অভিবাদন , না পুছে কুশল ,
পিতৃ নাম শুধাইলে উদ্যত মুষল ।
সগর্বে জিজ্ঞাসা করে, 'কি লয়ে বিচার !
শুনিলে বলিতে পারি কথা দুই চার ,
ব্যাখ্যায় করিতে পারি উলট পালট ।'
সমস্বরে কহে সবে ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

স্বপ্নকথা শুনি মুখ গম্ভীর করিয়া
কহিল গৌড়ীয় সাধু প্রহর ধরিয়া ,
'নিতান্ত সরল অর্থ, অতি পরিষ্কার ¬
বহু পুরাতন ভাব, নব আবিষ্কার ।
ত্রম্বকের ত্রিনয়ন ত্রিকাল ত্রিগুণ
শক্তিভেদে ব্যাক্তিভেদ দ্বিগুন বিগুণ ।
বিবর্তন আবর্তন সম্বর্তন আদি
জীবশক্তি শিবশক্তি করে বিসম্বাদী ।
আকর্ষণ বিকর্ষণ পুরুষ প্রকৃতি
আনব চৌম্বক বলে আকৃতি বিকৃতি ।
কুশাগ্রে প্রবহমান জীবাত্মবিদ্যুৎ
ধারণা পরম শক্তি সেথায় উদ্ভূত ।
ত্রয়ী শক্তি ত্রিস্বরূপে প্রপঞ্চে প্রকট ,
সংক্ষেপে বলিতে গেলে ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

'সাধু সাধু সাধু ' রবে কাঁপে চারিধার ¬
সবে বলে পরিষ্কার অতি পরিষ্কার !'
দুর্বোধ যা-কিছু ছিল হয়ে গেল জল ,
শূন্য আকাশের মতো অত্যন্ত নির্মল ।
হাঁপ ছাড়ি উঠিলেন হবুচন্দ্ররাজ,
আপনার মাথা হতে খুলি লয়ে তাজ
পরাইয়া দিল ক্ষীণ বাঙালির শিরে ¬
ভরে তার মাথাটুকু পরে বুঝি ছিঁড়ে ।
বহুদিন পরে আজ চিন্তা গেল ছুটে ,
হাবুডুবু হবুরাজ্য নড়িচড়ি উঠে ।
ছেলেরা ধরিল খেলা বৃদ্ধেরা তামুক ¬
দন্ডে খুলে গেল রমণীর মুখ ।
দেশ-জোড়া মাথাধরা ছেড়ে গেল চট,
সবাই বুঝিয়া গেল ¬ হিং টিং ছট ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,

গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।

যে শুনিবে এই স্বপ্নমঙ্গলের কথা
সর্বভ্রম ঘুচে যাবে , নহিবে অন্যথা ।
বিশ্বে কভু বিশ্ব ভেবে হবে না ঠকিতে ,
সত্যেরে সে মিথ্যা বলি বুঝিবে চকিতে ।
যা আছে তা নাই আর নাই যাহা আছে ,
এ কথা জাজ্বল্যমান হবে তার কাছে ।
সবাই সরলভাবে দেখিবে যা-কিছু
সে আপন লেজুড় জুড়িবে তার পিছু ।
এস  ভাই, তোলো   হাই ,  শুয়ে পড়ো চিত,
অনিশ্চিত এ সংসারে এ কথা নিশ্চিত ¬
জগতে সকলই মিথ্যা, সব মায়াময় ,
স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয় ।
স্বপ্নমঙ্গলের কথা অমৃতসমান ,
গৌড়ানন্দ কবি ভনে, শুনে পুণ্যবান ।।


[শান্তিনিকেতন , ১৮ জ্যৈষ্ঠ , ১২৯৯ ]



                       পরশপাথর 


            খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
   মাথায় বৃহৎ জটা                 ধূলায় কাদায় কটা,
        মলিন ছায়ার মতো ক্ষীণ কলেবর।
   ওষ্ঠে অধরেতে চাপি            অন্তরের দ্বার ঝাঁপি
        রাত্রিদিন তীব্র জ্বালা জ্বেলে রাখে চোখে।
   দুটো নেত্র সদা যেন             নিশার খদ্যোত-হেন
        উড়ে উড়ে খোঁজে কারে নিজের আলোকে।
   নাহি যার চালচুলা            গায়ে মাখে ছাইধুলা
        কটিতে জড়ানো শুধু ধূসর কৌপীন,
   ডেকে কথা কয় তারে        কেহ নাই এ সংসারে
        পথের ভিখারি হতে আরো দীনহীন,
   তার এত অভিমান,            সোনারুপা তুচ্ছজ্ঞান,
        রাজসম্পদের লাগি নহে সে কাতর,
   দশা দেখে হাসি পায়          আর কিছু নাহি চায়
        একেবারে পেতে চায় পরশপাথর!
        সম্মুখে গরজে সিন্ধু অগাধ অপার।
   তরঙ্গে তরঙ্গ উঠি                 হেসে হল কুটিকুটি
        সৃষ্টিছাড়া পাগলের দেখিয়া ব্যাপার।
আকাশ রয়েছে চাহি,           নয়নে নিমেষ নাহি,
        হু হু করে সমীরণ ছুটেছে অবাধ।
সূর্য ওঠে প্রাতঃকালে           পূর্ব গগনের ভালে,
        সন্ধ্যাবেলা ধীরে ধীরে উঠে আসে চাঁদ।
জলরাশি অবিরল                 করিতেছে কলকল,
        অতল রহস্য যেন চাহে বলিবারে।
কাম্য ধন আছে কোথা        জানে যেন সব কথা,
        সে-ভাষা যে বোঝে সেই খুঁজে নিতে পারে।
কিছুতে ভ্রূক্ষেপ নাহি,        মহা গাথা গান গাহি
        সমুদ্র আপনি শুনে আপনার স্বর।
কেহ যায়, কেহ আসে,        কেহ কাঁদে, কেহ হাসে,
        খ্যাপা তীরে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথর।
        একদিন, বহুপূর্বে, আছে ইতিহাস--
নিকষে সোনার রেখা            সবে যেন দিল দেখা--
        আকাশে প্রথম সৃষ্টি পাইল প্রকাশ।
মিলি যত সুরাসুর                  কৌতূহলে ভরপুর
        এসেছিল পা টিপিয়া এই সিন্ধুতীরে।
অতলের পানে চাহি                নয়নে নিমেষ নাহি
        নীরবে দাঁড়ায়ে ছিল স্থির নতশিরে।
বহুকাল স্তব্ধ থাকি               শুনেছিল মুদে আঁখি
        এই মহাসমুদ্রের গীতি চিরন্তন;
তার পরে কৌতূহলে           ঝাঁপায়ে অগাধ জলে
        করেছিল এ অনন্ত রহস্য মন্থন।
বহুকাল দুঃখ সেবি                নিরখিল, লক্ষ্মীদেবী
        উদিলা জগৎ-মাঝে অতুল সুন্দর।
সেই সমুদ্রের তীরে                  শীর্ণ দেহে জীর্ণ চীরে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        এতদিনে বুঝি তার ঘুচে গেছে আশ।
খুঁজে খুঁজে ফিরে তবু          বিশ্রাম না জানে কভু,
        আশা গেছে, যায় নাই খোঁজার অভ্যাস।
বিরহী বিহঙ্গ ডাকে               সারা নিশি তরুশাখে,
        যারে ডাকে তার দেখা পায় না অভাগা।
তবু ডাকে সারাদিন              আশাহীন শ্রান্তিহীন,
        একমাত্র কাজ তার ডেকে ডেকে জাগা।
আর-সব কাজ ভুলি            আকাশে তরঙ্গ তুলি
        সমুদ্র না জানি কারে চাহে অবিরত।
যত করে হায় হায়           কোনোকালে নাহি পায়,
        তবু শূন্যে তোলে বাহু, ওই তার ব্রত।
কারে চাহি ব্যোমতলে           গ্রহতারা লয়ে চলে,
        অনন্ত সাধনা করে বিশ্বচরাচর।
সেইমতো সিন্ধুতটে                ধূলিমাথা দীর্ঘজটে
        খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশপাথর।
        একদা শুধাল তারে গ্রামবাসী ছেলে,
"সন্ন্যাসীঠাকুর, এ কী,         কাঁকালে ও কী ও দেখি,
        সোনার শিকল তুমি কোথা হতে পেলে।'
সন্ন্যাসী চমকি ওঠে               শিকল সোনার বটে,
        লোহা সে হয়েছে সোনা জানে না কখন।
একি কাণ্ড চমৎকার,            তুলে দেখে বার বার,
        আঁখি কচালিয়া দেখে এ নহে স্বপন।
কপালে হানিয়া কর               বসে পড়ে ভূমি-'পর,
        নিজেরে করিতে চাহে নির্দয় লাঞ্ছনা;
পাগলের মতো চায়--           কোথা গেল, হায় হায়,
        ধরা দিয়ে পলাইল সফল বাঞ্ছনা।
কেবল অভ্যাসমত                  নুড়ি কুড়াইত কত,
        ঠন্‌ ক'রে ঠেকাইত শিকলের 'পর,
চেয়ে দেখিত না, নুড়ি          দূরে ফেলে দিত ছুঁড়ি,
        কখন ফেলেছে ছুঁড়ে পরশ-পাথর।
        তখন যেতেছে অস্তে মলিন তপন।
আকাশ সোনার বর্ণ,              সমুদ্র  গলিত স্বর্ণ,
        পশ্চিম দিগ্বধূ দেখে সোনার স্বপন।
সন্ন্যাসী আবার ধীরে               পূর্বপথে যায় ফিরে
        খুঁজিতে নূতন ক'রে হারানো রতন।
সে শকতি নাহি আর                 নুয়ে পড়ে দেহভার
        অন্তর লুটায় ছিন্ন তরুর মতন।
পুরাতন দীর্ঘ পথ                 পড়ে আছে মৃতবৎ
        হেথা হতে কত দূর নাহি তার শেষ।
দিক হতে দিগন্তরে               মরুবালি ধূ ধূ করে,
        আসন্ন রজনী-ছায়ে ম্লান সর্বদেশ।
অর্ধেক জীবন খুঁজি              কোন্‌ ক্ষণে চক্ষু বুজি
        স্পর্শ লভেছিল যার এক পল ভর,
বাকি অর্ধ ভগ্ন প্রাণ              আবার করিছে দান
        ফিরিয়া খুঁজিতে সেই পরশ-পাথর।



 [ ১৯ জ্যৈষ্ঠ  শান্তি নিকেতন ১২৯৯]



                   দুই পাখি 


খাঁচার পাখি ছিল     সোনার খাঁচাটিতে
               বনের পাখি ছিল বনে।
একদা কী করিয়া     মিলন হল দোঁহে,
        কী ছিল বিধাতার মনে।
বনের পাখি বলে,  খাঁচার পাখি ভাই,
       বনেতে যাই দোঁহে মিলে।
খাঁচার পাখি বলে-- বনের পাখি, আয়
        খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।'
                 বনের পাখি বলে-- "না,
আমি     শিকলে ধরা নাহি দিব।'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি     কেমনে বনে বাহিরিব!'
বনের পাখি গাহে বাহিরে বসি বসি
                 বনের গান ছিল যত,
খাঁচার পাখি পড়ে শিখানো বুলি তার--
                 দোঁহার ভাষা দুইমতো।
বনের  পাখি বলে, খাঁচার পাখি ভাই,
        বনের গান গাও দিখি।
খাঁচার পাখি বলে, বনের পাখি ভাই,
খাঁচার গান লহো শিখি।
          বনের পাখি বলে-- না,
আমি     শিখানো গান নাহি চাই।'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
আমি     কেমনে বন-গান গাই।'
         বনের পাখি বলে, "আকাশ ঘননীল,
        কোথাও বাধা নাহি তার।'
খাঁচার পাখি বলে, "খাঁচাটি পরিপাটি
        কেমন ঢাকা চারি ধার।'
বনের পাখি বলে, "আপনা ছাড়ি দাও
        মেঘের মাঝে একেবারে।'
খাঁচার পাখি বলে, নিরালা সুখকোণে
        বাঁধিয়া রাখো আপনারে!'
        বনের পাখি বলে-- "না,
সেথা     কোথায় উড়িবারে পাই!'
        খাঁচার পাখি বলে-- "হায়,
মেঘে     কোথায় বসিবার ঠাঁই!'
এমনি দুই পাখি দোঁহারে ভালোবাসে
        তবুও কাছে নাহি পায়।
খাঁচার ফাঁকে ফাঁকে পরশে মুখে মুখে,
        নীরবে চোখে চোখে চায়।
দুজনে কেহ কারে বুঝিতে নাহি পারে,
        বুঝাতে নারে আপনায়।
দুজনে একা একা ঝাপটি মরে পাখা,
        কাতরে কহে, "কাছে আয়!'
        বনের পাখি বলে--না,
কবে     খাঁচার রুধি দিবে দ্বার।
        খাঁচার পাখি বলে--হায়,
মোর     শকতি নাহি উড়িবার।

[শাহাজাদপুর  ১৯ আষাঢ়  ১২৯৯]




           যেতে নাহি দিব


দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর ।
জনশুন্য পল্লীপথে ধূলি উড়ে যায়
মধ্যাহ্নবাতাসে। স্নিগ্ধ অশ্বত্থের ছায়
ক্লান্ত বৃদ্ধা ভিখারিনি জীর্ণ বস্ত্র পাতি
ঘুমায়ে পড়েছে।  যেন রৌদ্রময়ী রাতি
ঝাঁ ঝাঁ করে চারি দিকে নিস্তব্ধ নিঃঝুম -
শুধু মোর ঘরে নাহি বিশ্রামের ঘুম ।।

গিয়েছে আশিন। পূজার ছুটির শেষে
ফিরে  যেতে হবে আজি বহুদূর দেশে
 কর্মস্থানে।  ভৃত্যগণ ব্যস্ত হয়ে
বাঁধিছে জিনিস-পত্র দরাদড়ি লয়ে -
হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি এ ঘরে, ও ঘরে ।
ঘরের গৃহিণী , চক্ষু ছলছল করে,
ব্যথিছে বক্ষের কাছে পাষাণের ভার -
তবুও সময় তার নাহি কাঁদিবার
একদণ্ড তরে। বিদায়ের আয়োজনে
ব্যস্ত হয়ে ফিরে, যথেষ্ট না হয় মনে
যত বাড়ে বোঝা।  আমি বলি,  'এ কি কান্ড !
এত ঘট, এত পট, হাঁড়ি সরা ভান্ড,
বোতল বিছানা বাক্স, রাজ্যের বোঝাই
কী করিব লয়ে ! কিছু এর রেখে যাই,
কিছু লই সাথে ।'

                সে কথায় কর্ণপাত
নাহি করে কোনজন।  'কি জানি দৈবাৎ
এটা ওটা আবশ্যক যদি হয় শেষে
তখন কোথায় পাবে বিভুঁই বিদেশে !
সোনামুগ সরুচাল সুপারি ও পান,
ও হাড়িতে ঢাকা আছে দুই-চারিখান
গুড়ের পাটালি ; কিছু ঝুনা নারিকেল,
দুই ভান্ড ভালো রাই সরিষার তেল,
আমসত্ত্ব আমচুর , সেরদুই দুধ ;
এই-সব শিশি কৌটা ওষুধ-বিষুধ।
মিষ্টান্ন রহিল কিছু হাঁড়ির ভিতরে -
মাথা খাও ভুলিও না, খেয়ো মনে করে ।'
বুঝিনু যুক্তির কথা বৃথা বাক্যব্যয়
বোঝাই হইল উঁচু পর্বতের ন্যায়।
তাকানু ঘড়ির পানে , তার পর ফিরে
চাহিনু প্রিয়ার মুখে , কহিলাম ধীরে
'তবে আসি' । অমনি ফিরায়ে মুখখানি
নতশিরে চক্ষু-'পরে বস্ত্রাঞ্চল টানি
অমঙ্গল-অশ্রুজল করিল গোপন ।

বাহিরে দ্বারের কাছে বসি অন্যমন
কন্যা মোর চারি বছরের।  এতক্ষন
অন্য দিনে হয়ে যেত স্নান সমাপন ;
দুটি অন্য মুখে না তুলিতে আঁখিপাতা
মুদিয়া অসিত ঘুমে - আজি তার মাতা
দেখে নাই তারে।  এত বেলা হয়ে যায় ,
নাই স্নানাহার।  এতক্ষন ছায়াপ্রায়
ফিরিতেছিল সে  মোর কাছে কাছে ঘেঁষে
চাহিয়া দেখিতেছিল মৌন নির্নিমেষে
বিদায়ের আয়োজন।  শ্রান্তদেহে এবে
বাহিরের দ্বারপ্রান্তে কি জানি কি ভেবে
চুপিচাপি বসে ছিল।  কহিনু যখন
'মা গো, আসি' সে কহিল বিষণ্ণনয়ন
ম্লান মুখে , 'যেতে আমি দিব না তোমায়। '
যেখানে আছিল বসে রহিল সেথায় ,
ধৰিলে না বাহু মোর, রুধিল না দ্বার ,
শুধু নিজ হৃদয়ের স্নেহ-অধিকার
প্রচারিল 'যেতে আমি দিব না তোমায়। '
তবুও সময় হল শেষ , তবু হায়
যেতে দিতে হল ।।

                 ওরে মোর মূঢ় মেয়ে,
কে রে তুই, কোথা হতে কি শক্তি পেয়ে
কহিলি এমন কথা এত স্পর্ধাভরে
'যেতে আমি দিব না তোমায়' ! চরাচরে
কাহারে রাখিবি ধরে দুটি ছোটো হাতে
গরবিনি, সংগ্রাম করিবি কার সাথে
বসি গৃহদ্বারপ্রান্তে শ্রান্তক্ষুদ্রদেহ
শুধু লয়ে ওইটুকু বুক-ভরা স্নেহ !
ব্যথিত হৃদয় হতে বহু ভয়ে লাজে
মর্মের প্রার্থনা শুধু ব্যাক্ত করা সাজে
এ জগতে।  শুধু বলে রাখা জিতে দিতে ইচ্ছা নাহি
হেনো কথা কে বলিতে পারে
যেতে নাহি দিবো।  শুনি তোর শিশুমুখে
স্নেহের প্রবল গর্ববানী , সকৌতুকে
হাসিয়া সংসার টেনে নিয়ে গেলো মোরে ;
তুই শুধু পরাভূত চোখে জল ভ'রে
দুয়ারে রহিলি বসে ছবির মতন -
আমি দেখে চলে এনু মুছিয়া নয়ন ।।

চলিতে চলিতে পথে হেরি দুই ধারে
শরতের শস্যক্ষেত নত  শস্যভারে
রৌদ্র পোহাইছে।  তরুশ্রেণী উদাসীন
রাজপথপাশে , চেয়ে আছে সারাদিন
আপন ছায়ার পানে।  বহে খর বেগ
শরতের ভরা গঙ্গা।  শুভ্র খণ্ডমেঘ
মাতৃদুগ্ধ পরিতৃপ্ত সুখনিদ্রারত
সদ্যজাত সুকুমার গোবৎসের মতো
নীলাম্বরে শুয়ে।  দীপ্ত রৌদ্রে অনাবৃত
যুগযুগান্তরক্লান্ত দিগন্তবিস্তৃত
ধরেননি পেইন চেয়ে ফেলিনু নিঃশ্বাস ।।

কি গভীর দুঃখে  মগ্ন সমস্ত আকাশ ,
সমস্ত পৃথিবী ! চলিতেছি যতদূর
শুনিতেছি একমাত্র মর্মান্তিক সুর
'যেতে আমি  দিব না তোমায়' ! ধরণীর
প্রান্ত হতে নীলাভ্রের সর্বপ্রান্ততীর
ধন্নিতেছে চোরকাল অনাদ্যান্ত রবে
'যেতে নাহি দিব। ' জিতে নাহি দিব। ' সবে
কহে , 'যেতে নাহি দিব। ' তৃণ ক্ষুদ্র অতি
 তারেও বাঁধিয়া রাখে মাতা বসুমতী
কহিছে প্রানপনে , 'যেতে নাহি দিব। '
 আয়ুক্ষীণ দীপঃমুখে শিক্ষা নিব-নিব  -
 আঁধারের গ্রাস হতে কে টানিছে তারে,
কহিতেছে শতবার 'যেতে দিব না রে ' ।
এ অনন্ত চরাচরে স্বর্গমরতো ছেয়ে
সবচেয়ে পুরাতন কথা , সবচেয়ে
গভীর ক্রন্দন 'যেতে নাহি দিব ' । হায় ,
তবে যেতে দিতে হয় , তবে চলে যায়।
চলিতেছে এমনি অনাদিকাল হতে।
প্রলয়সমুদ্রবাহী  সৃজনের স্রোতে
প্রসারিত - ব্যগ্রবাহু জ্বলন্ত-আঁখিতে
'দিব না দিব না যেতে 'ডাকিতে ডাকিতে
হুহু করে তীব্র বেগে চলে যায় সবে
পূর্ণ করি বিশ্বতট আর্ত কলরবে।
সম্মুখ-উর্মিরে ডাকে পশ্চাতের ঢেউ
'দিব না দিব না যেতে ' । নাহি শুনে কেউ,
নাহি কোনো সাড়া ।।

                       চারি দিক হতে আজি
অবিশ্রাম কর্ণে মোর উঠিতেছে বাজি
সেই বিশ্বমর্মভেদী করুন ক্রন্দন
মোর কন্যাকণ্ঠস্বরে।  শিশুর মতন
বিশ্বের  অবোধ বাণী।  চিরকাল ধরে
যাহা পায়  তাই সে হারায় ; তবু তো রে
শিথিল হলো না মুষ্টি , তবু অবিরত
সেই চারি বৎসরের কন্যাটির মতো
অক্ষুন্ন প্রেমের গর্বে কহিছে সে ডাকি
যেতে নাহি দিব ' । ম্লানমুখ, অশ্রু আঁখি,
দন্ডে দন্ডে  পলে পলে টুটিছে গরব ,
তবু প্রেম কিছুতে না মানে পরাভব -
তবু বিদ্রোহের ভাবে রুদ্ধকণ্ঠে কয়
'যেতে নাহি দিব' । যতবার পরাজয়
ততবার কহে , 'আমি  ভালোবাসি যারে
সে কি কভু আমা হতে দূরে যেতে পারে ?
আমার আকাঙ্খা-সম এমন অকুল
এমন প্রবল বিশ্বে কিছু আছে আর !
এত বলি দর্প ভরে করে সে প্রচার
'যেতে নাহি দিব' । তখনি দেখিতে পায় ,
শুষ্ক তুচ্ছ ধূলি সম উড়ে চলে যায়
একটি নিঃশ্বাসে তার আদরের ধন ;
অশ্রুজলে ভেসে যায় দুইটি নয়ন ,
ছিন্নমূল তরুসম পড়ে পৃথ্বীতলে
হতগর্ব নতশির।  তবু প্রেম বলে ,
'সত্যভঙ্গ হবে না বিধির ।আমি তাঁর
পেয়েছি সাক্ষর দেওয়া মহা অঙ্গীকার
চির অধিকারলিপি । তাই স্ফীতবুকে
সর্বশক্তি মরণের মুখের সম্মুখে
দাঁড়াইয়া সুকুমার ক্ষীন তনুলতা
বলে মৃত্যু তুমি নাই । - হেনো গর্বকথা
মৃত্যু হাসে বসি । মরনপীড়িত সেই
চিরজীবী প্রেম আচ্ছন্ন করেছে এই
অনন্ত সংসার , বিসন্ননয়ন 'পরে
অশ্রুবাষ্প-সম, ব্যাকুল আশংকাভরে
চির কম্পমান । আশাহীন শ্রান্ত আশা
তানিয়া রেখেছে এক বিষাদ কুয়াশা
বিশ্বময় । আজি যেন পড়িছে নয়নে
দুখানি অবোধ বাহু বিফল বাঁধনে
জড়ায়ে পড়িয়া আছে নিখিলের ঘিরে
স্তব্ধ সকাতর।  চঞ্চল স্রোতের নীরে
পড়ে আছে একখানি অচঞ্চল ছায়া -
অশ্রুবৃষ্টিভরা কোন মেঘের সে মায়া ।।

তাই আজি শুনিতেছি তরুর মর্মরে
এতো ব্যাকুলতা ; অলস ঔদাস্যাভরে
মধ্যান্যের তপ্তবায়ু মিছে খেলা করে
শুষ্ক পত্র  লয়ে।  বেলা ধীরে যায় চলে
ছায়া দীর্ঘতর করি অশত্থের তলে।
মেঠো সুরে কাঁদে যেন অনন্তের বাঁশি
বিশ্বের প্রান্তর মাঝে । শুনিয়া উদাসী
বসুন্ধরা বসিয়া আছেন এলোচুলে
দূরব্যাপী শস্যক্ষেত্রে জাহ্নবীর কূলে
একখানি রৌদ্রপীত হিরণ্য অঞ্চল
বক্ষে টানি দিয়া ; স্থির নয়নযুগল
দূর নীলাম্বরে মগ্ন ; মুখে নাহি বাণী।
দেখিলাম তার সেই ম্লানমুখখানি
সেই দ্বারপ্রান্তে লীন , স্তব্ধ , মর্মাহত
মোর চারি বৎসরের কন্যাটির মতো ।।




                  মানসসুন্দরী

আজ কোনো কাজ নয়।  সব ফলে দিয়ে
ছন্দবদ্ধগ্রন্থগীত, এস তুমি প্রিয়ে ,
আজন্মসাধন সুন্দরী আমার ,
কবিতা কল্পনালতা।  শুধু একবার
কাছে বোসো।  আজ শুধু কুজন গুঞ্জন
তোমাতে আমাতে, শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এইসন্ধ্যা কিরণের সুবর্ণমদিরা -
যতক্ষন শরীরের শিরা উপশিরা
লাবণ্য প্রবাহভরে ভরি নাহি উঠে ,
যতক্ষণ মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ , ভুলে যাই সব
কি আশা মেটে  নি প্রাণে , কি সংগীত রব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কি আনন্দসুধা,
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা
না মিটায়ে গিয়েছে শুকায়ে। এই শান্তি
এই মধুরতা দিক সৌম্য ম্লান কান্তি
জীবনের দুঃখ দৈন্য - অতৃপ্তির 'পর
করুনকোমল আভা গভীর সুন্দর ।।

বীণা ফেলে. দিয়ে এস মানসসুন্দরী,
দুটি রিক্তহস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও - মৃনালপরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি. উঠে মর্মান্ত হরষে -
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল ,
মুগ্ধতনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়াবন্ধ বুঝি টুটে টুটে ।
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শে তব । সুমধুর প্রিয়সম্বোধনে
ডাকো মোরে, বলো প্রিয়, বলো প্রিয়তম !
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে বলে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাব ভরা ভাষা । অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিবে যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায় না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিমবর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধর পুটে - ভক্তভৃঙ্গ-তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক হাসিস্তরে-স্তরে
সরসসুন্দর । নবস্ফুটপুষ্পসম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে ধোরো । আনন্দ আভায়
বড়ো-বড়ো দুটি চক্ষু পল্লব প্রচ্ছায়
রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে । যদি. চোখে জল আসে
কাঁদিব দুজনে । যদি ললিত কপোলে
মৃদু হাসি ভাসি উঠে , বসি মোর কোলে ,
বক্ষ বাঁধি বাহুপাশে, স্কন্ধে মুখ রাখি
হাসিয়া নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি ।
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
বলে যেয়ো কথা তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের মতো - অর্ধেক রজনী ধরি
কত না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি । যদি গান
ভালো লাগে , গেয়ো গান , যদি মুগ্ধপ্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রব প্রিয়া ।
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে । অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মতো । সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পনে করে পদার্পন নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে । যামিনী শয়ন তার
দেয় বিছাইয়া একখানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে । দোঁহে মোরা রব চাহি
অপার তিমিরে । আর কোথা কিছু নাহি ,
শুধু মোর করে তব করতলখানি ;
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী
অসীম নির্জনে | বিষন্ন বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি ;
শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয়মগন
বাকি আছে একখানি শংকিত মিলন,
দুটি হাত, ত্রস্ত কপোতের মতো দুটি
বক্ষ দুরুদুরু; দুই প্রাণে আছে ফুটি
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা ।।

আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্যবিলাসে । অয়ি নিরভিমানিনী ,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য গগনের সৌন্দর্যের শশী ,
মনে আছে কবে কোন ফুল্ল যূথীবনে ,
বহুবাল্যকালে, দেখা হতো দুইজনে
আধো-চেনাশোনা ? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কি খেলা খেলাতে
সখী, আসিতে হাসিয়া তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকা মূর্তি - শুভ্রবস্ত্র পরি
ঊষার কিরণধারে সদ্যস্নান করি
বিকচকুসুমসম ফুল্লমুখখানি
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে - নিয়ে যেতে টানি
উপবনে কুড়াতে শেফালি । বারে বারে
শৈশবকর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুথিপত্র কেড়ে নিয়ে খড়ি ,
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি
পাঠশালা কারা হতে ; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্যভবনে ;
জনশুন্য গৃহছাদে আকাশের তলে
কী করিতে খেলা, কি বিচিত্র কথা বলে
ভুলতে আমারে - স্বপ্নসম চমৎকার,
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জানো তার ।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা , দুটি করে
সোনার বলয় ; দুটি কপোলের 'পরে
খেলিত. অলক ; দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক নির্মলনির্ঝরস্রোতে
চূর্ণরশ্মি-সম । দোঁহে দোঁহা ভালো ক'রে
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা ছুটাছুটি দুজনে সতত ,
কথাবার্তা - বেশবাস বিথান - বিতত ।।

তার পরে ১৪০


                         দুর্বোধ 

         তুমি মোরে  পার না বুঝিতে ?
প্রশান্ত বিষাদভরে           দুটি আঁখি প্রশ্ন করে
           অর্থ মোর চাহিছে খুঁজিতে ,
       চন্দ্রমা যেমন-ভাবে স্থির নতমুখে
            চেয়ে দেখে সমুদ্রের বুকে ।।

           কিছু আমি করিনি গোপন ।
যাহা আছে সব আছে      তোমার আখির কাছে
           প্রসারিত অবারিত মন ।
      দিয়েছি সমস্ত মোর করিতে ধারণা ,
        তাই মোরে বুঝিতে পারো না ?।

            এ যদি হইত শুধু মণি,
শত খন্ড করি তারে           সযত্নে বিবিধকারে
            একটি একটি করি গণি
    একখানি সূত্রে গাঁথি একখানি হার
            পরাতেম গলায় তোমার ।।

            এ যদি হইতো শুধু ফুল ,
সুগোল সুন্দর ছোটো,     উষালোকে ফোটো -ফোটো ,
             বসন্তের পবনে দোদুল –
       বৃন্ত হতে সযতনে অনিতাম তুলে ,
           পরায়ে দিতেম কালো চুলে ।।

            এ যে সখি , সমস্ত হৃদয় ।
কোথা জল কোথা কুল ,      দিক হয়ে যায় ভুল,
                অন্তহীন রহস্যনিলয় ।
       এ রাজ্যের আদি অন্ত, নাহি জান রানী ,
           এ তবু তোমার রাজধানী ।।

          কী তোমারে চাহি বুঝাইতে ?
গভীর হৃদয় মাঝে             নাহি জানে কি যে বাজে
          নিশিদিন নীরব সংগীতে ,
      শব্দহীন স্তব্ধতায় ব্যাপিয়া গগন
             রজনীর ধ্বনির মতন ।।

             এ যদি হইতো শুধু সুখ ,
 কেবল একটি হাসি অধরের প্রান্তে আসি
            আনন্দ করিত জাগরুক ।
        মুহূর্তে বুঝিয়া নিতে হৃদয়বারতা,
                  বলিতে হতো না কোনো কথা ।।

             এ যদি হইতো শুধু সুখ,
দুটি বিন্দু অশ্রুজল          দুই চক্ষে ছলছল ,
              বিষন্ন অধর, ম্লানমুখ –
      প্রত্যক্ষ দেখিতে পেতে অন্তরের ব্যাথা ,
             নীরবে প্রকাশ হত কথা ।।

             এ যে, সখী, হৃদয়ের প্রেম –
সুখ দুঃখ বেদনার            আদি অন্ত নাহি যার ,
             চিরদৈন্য, চিরপূর্ণ হেম ।
     নব নব ব্যাকুলতা জাগে দিবারাতে ,
         তাই আমি না পারি বুঝাতে ।।

           নাই বা বুঝিলে তুমি মোরে ।
চিরকাল চোখে চোখে         নূতন-নূতনালোকে
          পাঠ করো রাত্রিদিন ধরে ।
     বুঝা যায় আধো প্রেম, আধখানা মন –
           সমস্ত কে বুঝেছে কখন ।।

[পদ্মায় রাজশাহীর পথে ১১ চৈত্র ১২৯৯]

                               ঝুলন

আমি      পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণখেলা
                       নিশীথবেলা  ।
              সঘন বরষা, গগন আঁধার
              হেরো বারিধারে কাঁদে চারিধার –
              ভীষণ রঙ্গে ভবতরঙ্গে ভাসাই ভেলা ;
              বাহির হয়েছি স্বপ্নশয়ন করিয়া হেলা
                                   রাত্রিবেলা ।।

ওগো,      পবনে গগনে সাগরে আজিকে কি কল্লোল !
                                   দে দোল দোল ।
              পশ্চাৎ হতে হাহা ক'রে হাসি
              মত্ত ঝটিকা ঠেলা দেয় আসি,
              যেন এ লক্ষ যক্ষ শিশুর অট্টরোল ।
আকাশে পাতালে পাগলে মাতালে হট্টগোল ।
              দে দোল দোল ।।

আজি     জাগিয়া উঠিয়া পরান আমার বসিয়া আছে
                                 বুকের কাছে ।
              থাকিয়া থাকিয়া উঠিছে কাঁপিয়া ।
              ধরিছে আমার বক্ষ চাপিয়া ,
নিঠুর নিবিড় বন্ধনসুখে হৃদন নাচে ;
ত্রাসে উল্লাসে পড়ান আমার ব্যাকুলিয়াছে
বুকের কাছে ।।

হায়,        এতকাল আমি রেখেছিনু তারে যতনভরে
                                   শয়ন-'পরে ।
              ব্যাথা পাচ্ছে লাগে - দুঃখ পাছে জাগে
              নিশিদিন তাই বহু অনুরাগে
              বাসরশয়ন করেছি রচনা কুসুমথরে ;
              দুয়ার রুধিয়া রেখেছিনু তারে গোপন ঘরে
                                    যতনভরে ।।
কত.       সোহাগ করেছি চুম্বন করি নয়নপাতে
                                    স্নেহের সাথে ।
             শুনায়েছি তারে মাথা রাখি পাশে
             কত প্রিয়নাম মৃদুমধুভাষে ,
             গুঞ্জরতান করিয়াছি গান জ্যোৎস্নারাতে ;
             যা কিছু মধুর দিয়েছিনু তার দুখানি হাতে
                                    স্নেহের সাথে ।।

শেষে     সুখের শয়নে শ্রান্ত পরান আলসরসে
                                    আবেশবশে ।
            পরশ করিলে জাগে না আসে আর ,
            কুসুমের হার লাগে গুরুভার ,
            ঘুমে, জাগরণে মিশি একাকার নিশিদিবসে
           বেদনাবিহীন অসাড় বিরাগ মরমে পশে
                                   আবেশবসে ।।

ঢালি       মধুরে মধুর বধূরে আমার হারাই বুঝি,
                            পাই না খুঁজি ।
              বাসরের দীপ নিবে নিবে আসে,
              ব্যাকুল নয়নে হেরি চারি পাশে
              শুধু রাশি রাশি শুষ্ক কুসুম হয়েছে পুঁজি ;
              অতল স্বপ্নসাগরে ডুবিয়া মরি যে যুঝি
                            কাহারে খুঁজি ।।

তাই         ভেবেছি আজিকে খেলিতে হইবে নতুন খেলা
                            রাত্রিবেলা
               মরণ দোলায় ধরি রশিগাছি
               বসিব দুজনে বোরো কাছাকাছি ,
               ঝঞ্ঝা আসিয়া অট্টহাসিয়া মারিবে ঠেলা ;
               আমাতে প্রাণেতে খেলিব দুজনে ঝুলনখেলা
                            নিশীথবেলা ।।

               দে দোল দোল ।
               দে দোল দোল ।
      এ মহাসাগরে তুফান তোল
বধূরে আমার পেয়েছি আবার, ভরেছে কোল ।
প্রিয়ারে আমার তুলেছে জাগায়ে প্রলয় রোল ।
বক্ষশোণিতে উঠেছে আবার কি হিল্লোল !
ভিতরে বাহিরে জেগেছে আমার কি কল্লোল !
         উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল,
         উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল ,
বাজে কঙ্কন বাজে কিঙ্কিণী – মত্তবোল ।
                 দে দোল দোল ।।

আয় রে ঝঞ্ঝা পরানবধূর
আবরণরাশি করিয়া দে দূর ,
করি লুন্ঠন অবগুন্ঠন -বসন খোল ।
                দে দোল দোল ।।

প্রাণেতে আমাতে মুখোমুখি আজ
চিনি লব দোঁহে ছাড়ি ভয় লাজ ,
বক্ষে বক্ষে পরশিব ভাবে বিভোল ।
                দে দোল দোল ।
স্বপ্ন টুটিয়া বাহিরিছে আজ দুটো পাগল ।
                দে দোল দোল ।।

[রামপুর বোয়ালিয়া , ১৫ চৈত্র , ১২৯৯]

সমুদ্রের প্রতি

                                     হৃদয়যমুনা

যদি      ভরিয়া লইবে কুম্ভ                 এস , ওগো, এস মোর
                                     হৃদয়নীরে ।
            তলতল ছলছল                      কাঁদিবে গভীর জল
                       ওই দুটি সুকোমল চরণ ঘিরে ।
            আজি বর্ষা গাঢ়তম ,                   নিবিড় কুন্তলসম
                     মেঘ নামিয়াছে মম দুইটি তীরে ।
            ওই যে শবদ চিনি —              নুপুর রিনিকি-ঝিনি,
                কে গো তুমি একাকিনী আসিছ ধীরে
  যদি    ভরিয়া লইবে কুম্ভ                   এস , ওগো, এস মোর
                                      হৃদয়নীরে ।

যদি      কলস ভাসায়ে জলে                বসিয়া থাকিতে চাও
                                   আপনা ভুলে —
           হেথা শ্যাম দুর্বাদল,                     নবনিল নভস্তল ,
                          বিকশিত বনস্থল বিকচ ফুলে ।
           দুটি কালো আঁখি দিয়া               মন যাবে বাহিরিয়া
                         অঞ্চল খসিয়া গিয়া পড়িবে খুলে ,
           চাহিয়া বঞ্জুলবনে                    কি জানি পড়িবে মনে
                         বসি কুঞ্জতৃণাসনে শ্যামল কূলে ।
            যদি কলস ভাসায়ে জলে          বসিয়া থাকিতে চাও
                                      আপনা ভুলে ।।

যদি      গাহন করিতে চাও                     এস নেমে এস হেথা
                                    গহনতলে ।
           নীলাম্বরে কিবা কাজ,         তীরে ফেলে আসো আজ ,
                     ঢেকে দিবে সব লাজ সুনীল জলে ।
           সোহাগ তরঙ্গরাশি             অঙ্গখানি নিবে গ্রাসি ,
                      উচ্ছসি পড়িবে আসি উরসে গলে।
           ঘুরে ফিরে চারি পাশে          কভু কাঁদে কভু হাসে
                         কুলুকুলু কলভাষে কত কি ছলে !
যদি      গাহন করিতে চাও              এসো নেমে এস হেথা
                                  গহন তলে ।।
যদি       মরণ  লভিতে চাও             এস তবে ঝাঁপ দাও
                                 সলিলমাঝে ।
            স্নিগ্ধ শান্ত সুগভীর ,            তল, নাহি তীর —
                     মৃত্যুসম নীল নীর স্থির বিরাজে ।
            নাহি রাত্রি দিনমান —          আদি অন্ত পরিমাণ,
                   সে অতলে গীতগান কিছু না বাজে ।
            যাও সব যাও ভুলে,               নিখিল বন্ধন খুলে
                   ফেলে দিয়ে এসো কূলে সকল কাজে ।
            যদি মরণ লভিতে চাও          এস তবে ঝাঁপ দাও
                                    সলিলমাঝে ।।

[১২ আষাঢ় ১৩০০]



                       ব্যার্থ যৌবন

আজি      যে রজনী যায় ফিরাইব যায় কেমনে !
কেন         নয়নের জল ঝরিছে বিফল নয়নে  ।
               এ বেশভূষণ লহো সখী , লহো –
               এ কুসুমমালা হয়েছে অসহ ,
               এমন যামিনী কাটিল বিরহশয়নে ।
আজি      যে রজনী যায় ফিরাইব যায় কেমনে ।।

আমি       বৃথা অভিসারে এ যমুনাপারে এসেছি ।
বহি          বৃথা মনোআশা এতো ভালোবাসা বেসেছি ।
               শেষে নিশিশেষে বদন মলিন ,
               ক্লান্ত চরণ, মন উদাসীন ,
               ফিরিয়া চলেছি কোন সুখহীন ভবনে !

হায়,         যে রজনী যায় ফিরাইব যায় কেমনে ।।
কত         উঠেছিল চাঁদ নিশীথ-অগাধ আকাশে ।
বনে         দুলেছিল ফুল গন্ধব্যাকুল আকাশে ।
               তরুমর্মর নদীকলতান
               কানে লেগেছিল স্বপ্নসমান ,
               দূর হতে আসি পশেছিল গান শ্রবনে ।
আজি      সে রজনী যায়, ফিরাইব যায় কেমনে ।।

মনে        লেগেছিল হেন, আমারে সে যেন ডেকেছে ।
যেন        চিরযুগ ধরে মোর মনে করে রেখেছে ।
              সে আনিবে  বহি ভরা অনুরাগ ,
              যৌবননদী করিবে সজাগ,
              আসিবে নিশীথে, বাঁধিবে সোহাগে বাঁধনে ।
আহা      সে রজনী যায় ফিরাইব যায় কেমনে ।।

ওগো,      ভোলা ভালো তবে , কাঁদিয়া কি হবে মিছে আর ?
যদি.       যেতে হল হায়, প্রাণ কেন চায় পিছে আর ?
              কুঞ্জদুয়ারে অবোধের মতো
              রজনী প্রভাতে বসে রবে কত !
             এবারের মতো বসন্ত গত জীবনে ।
হায়,       যে রজনী যায় ফিরাইব যায় কেমনে  ।।

[১৬ আষাঢ়, ১৩০০]


                         প্রত্যাখ্যান

       অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।
       অমন সুধাকরুন সুরে গেয়ো না।
সকালবেলা সকল কাজে        আসিতে যেতে পথের মাঝে
        আমারি এ আংগিনা দিয়ে যেয়ো না
        অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না
     
        মনের কথা রেখেছি মনে যতনে ।
        ফিরিছ মিছে মাগিয়া সেই রতনে ।
তুচ্ছ অতি, কিছু সে নয় –         দুচারি-ফোঁটা -অশ্রু-ময়
        একটি শুধু শোণিতরাঙা বেদনা ।
        অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।।

        কাহার আশে দুয়ারে কর হানিছ !
        না জানি তুমি কি মোরে মনে মানিছ ।
রয়েছি হেথা লুকাতে লাজ     নাহিকো মোর রানীর সাজ –
            পড়িয়া আছি জীর্ণচীর বাসনা ।
             অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।।

           কি ধন তুমি এনেছো ভরি দু হাতে ?
            অমন করি যেয়ো না ফেলি ধুলাতে ।
এ ঋণ যদি শুধিতে চাই            কি আছে হেন, কোথায় পাই –
             জনম  তরে বিকাতে হবে আপনা
             অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।।

             ভেবেছি মনে, ঘরের কোণে রহিব ।
             গোপন দুখ আপন বুকে বহিব ।
কিসের লাগি করিব আশা –     বলিতে চাহি নাহিক ভাষা –
              রয়েছে সাধ, না জানি তার সাধনা ।
              অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।।

              যে সুর তুমি ভরেছ তবে বাঁশিতে
              উহার সাথে আমি কি পারি গাহিতে !
গাহিতে গেলে ভাঙিয়া গান     উছলি উঠে সকল প্রাণ,
              না মানে রোধ  অতি অবোধ রোদনা  ।
              অমন দীননয়নে তুমি চেয়ো না ।।

             এসেছো তুমি গলায় মালা ধরিয়া ,
             নবীনবেশ শোভনভুষা পরিয়া ।
হেথায় কথা কনকথালা             কোথায় ফুল কোথায় মালা –
             বাসরসেবা করিবে কেবা রচনা !
             অমন দীননয়নে  তুমি চেয়ো না ।।

              ভুলিয়া পথ এসেছো , সখা, এ ঘরে –
              অন্ধকারে মালা বদল কে করে !
সন্ধ্যা হতে কঠিন ভুঁয়ে                 একাকী আমি রয়েছি শুয়ে ,
               নিবায়ে দীপ জীবন নিশি - যাপনা ।
                অমন দীন নয়নে তুমি চেয়ো না ।।



                            লজ্জা

আমার হৃদয় প্রাণ           সকলই করেছি দান,
         কেবল শরমখানি রেখেছি ।
চাহিয়া নিনিজের পানে     নিশিদিন সাবধানে
          সযতনে আপনারে ঢেকেছি ।।

হে বঁধু , এ স্বচ্ছ বাস         করে মোর পরিহাস ,
          সতত রাখিতে নারি ধরিয়া
চাহিয়া আঁখির কোণে        তুমি হাস মনে মনে ,
           আমি তাই লাজে যাই মরিয়া ।।

দক্ষিণপবনভরে               অঞ্চল উড়িয়া পরে
          কখন যে নাহি পারি লখিতে ;
পুলকব্যাকুল হিয়া             অঙ্গে উঠে বিকশিয়া ,
         আবার চেতনা হয় চকিতে ।।

বন্ধ গৃহে করি বাস             রুদ্ধ যবে হয় শ্বাস
          আধেক বসনবন্ধ খুলিয়া
বসি গিয়া বাতায়নে            সুখসন্ধ্যা সমীরণে
           ক্ষণতরে আপনারে ভুলিয়া ।।

পূর্ণচন্দ্রকররাশি                 মূর্ছাতুর পড়ে আসি
            এই নরযৌবনের মুকুলে ।
অঙ্গ মোর ভালোবেসে         ঢেকে দেয় মৃদুহেসে
           আপনার লাবণ্যের দুকূলে ।।

মুখে বক্ষে কেশপাশে            ফিরে বায়ু খেলা-আশে
            কুসুমের গন্ধ ভাসে গগনে ;
হেনকালে তুমি এলে             মনে হয় স্বপ্ন ব'লে –
           কিছু আর নাহি থাকে স্মরণে ।।

থাক বঁধু , দাও. ছেড়ে,           ওটুকু নিয়োনা কেড়ে ,
            এ শরম দাও মোরে রাখিতে –
সকলের অবশেষ                   এইটুকু লাজলেশ
           আপনারে আধখানি ঢাকিতে ।।

ছলছল-দু'নয়ান                    করিয়ো না অভিমান –
           আমিও যে কত নিশি কেঁদেছি ;
বুঝতে পারি না যেন               সব দিয়ে তুমি কেন
            সবটুকু লাজ দিয়ে বেঁধেছি ।।

কেন যে তোমার কাছে              একটু গোপন আছে ,
            একটু রয়েছি মুখ হেলায়ে –
এ নহে গো অবিশ্বাস,               নহে, সখা, পরিহাস –
           নহে নহে ছলনার খেলা এ ।।

বসন্তনিশীথে বঁধু,                   লহো গন্ধ লহো মধু ,
          সোহাগে মুখের পানে তাকিয়ো –
দিয়ো দোল আসে পাশে ,        কোয়ো কথা মৃদু ভাষে ,
            শুধু এর বৃন্তটুকু রাখিয়ো ।।

সেটুকুতে ভর করি                এমন মাধুরী ধরি
           তোমা-পানে আছি আমি ফুটিয়া ,
এমন মোহনভঙ্গে                আমার সকল অঙ্গে
            নবীন লাবণ্য যায় লুটিয়া –

এমন সকল বেলা                পবনে চঞ্চল খেলা,
           বসন্ত-কুসুম মেলা দুধারি ।
শুন, বঁধু, শুন তবে              সকলই তোমার হবে –
           কেবল শরম থাক আমারি ।।

[২৮ আষাঢ় , ১৩০০]

পুরস্কার
বসুন্ধরা


             নিরুদ্দেশ যাত্রা

আর কত দূরে নিয়ে যাবে মোরে হে সুন্দরী ?
বলো কোন পার ভিড়িবে তোমার সোনার তরী ।
যখনি শুধাই ওগো বিদেশিনী,
তুমি হাসো শুধু, মধুরহাসিনী –
বুঝিতে না পারি কী জানি কি আছে তোমার মনে ।
নীরবে দেখাও অঙ্গুলি তুলি
অকুল সিন্ধু উঠিছে আকুলি ,
দূরে পশ্চিমে ডুবিছে তপন গগনকোণে ।
কি আছে হেথায় – চলেছি কিসের অন্বেষনে ?।

বলো দেখি মোরে, শুধাই তোমারে অপৱাচিতা –
ওই যেথা জ্বলে সন্ধ্যার কূলে দিনের চিতা,
ঝলিতেছে জল তরল অনল,
গলিয়া পড়িছে অম্বরতল,
দিকবধূ যেন ছলছল আঁখি অশ্রুজলে,
হেথায় কি আছে আলোয় তোমার
ঊর্মিমুখর সাগরের পার
মেঘচুম্বিত অস্তগিরির চরণতলে ?
তুমি হাসো শুধু মুখপানে চেয়ে কথা না ব'লে ।।

হুহু করে বায়ু ফেলিছে সতত দীর্ঘশ্বাস ।
অন্ধ আবেগে করে গর্জন জলোছ্বাস ।
সংশয়ময় ঘননীল নীর,
কোনো দিকে চেয়ে নাহি হেরি তীর ,
অসীম রোদন জগৎ প্লাবিয়া দুলিছে যেন ।
তারি 'পরে ভাসে তরণী হিরণ,
তারি 'পরে পড়ে সন্ধ্যকিরণ –
তারি মাঝে বসি এ নীরব হাসি হাসিছ কেন?
আমি তো বুঝিনা কি লাগি তোমার বিলাস হেন ।।

যখন প্রথম ডেকেছিলে তুমি ' কে যাবে সাথে ' –
চাহিনু বারেক তোমার নয়নে নবীন প্রাতে ।
দেখলে সমুখে প্রসারিয়া কর
পশ্চিমপানে অসীম সাগর ,
চঞ্চল আলো আসার মতন কাঁপিছে জলে ।
তরীতে উঠিয়া শুধানু তখন –
আছে কি হেথায় নবীন জীবন ,
আশার স্বপন ফলে কি হোথায় সোনার. ফলে ?
মুখপানে চেয়ে হাসিলে কেবল কথা না ব'লে ।।

তার পর কভু উঠিয়াছে মেঘ , কখনো রবি –
কখনো ক্ষুব্ধ. সাগর কখনো শান্ত ছবি ।
বেলা বহে যায় , পালে লাগে বায় ,
সোনার তরণী কোথা চলে যায়,
পশ্চিমে হেরি নামিছে তপন অস্তাচলে ।
এখন বারেক শুধাই তোমায় –
স্নিগ্ধ মরণ আছে কি হেথায়,
আছে কি শান্তি, আছে কি সুপ্তি তিমিরতলে ?
হাসিতেছ তুমি তুলিয়া নয়ন কথা না বলে ।।

আঁধার রজনী আসিবে এখনি মেলিয়া পাখা ,
সন্ধ্যা-আকাশে স্বর্ণ আলোক পড়িবে ঢাকা ।
শুধু ভাসে তব দেহ সৌরভ,
শুধু কানে আসে জলকলরব ,
গায়ে উড়ে পড়ে বায়ুভরে তব কেশের রাশি ।
বিকলহৃদয় বিবশশরীর
ডাকিয়া তোমারে কহিব অধীর -
'কোথা আছ ওগো , করহ পরশ নিকটে আসি ।'
কহিবে না কথা , দেখিতে পাব না নীরব হাসি ।।


[২৭ অগ্রহায়ণ, ১৩০০]




A road trip to Gelephu in Indo-Bhutan Border

I was in my home town Bongaigaon for Puja Vacations. This is the time of the year when we get some time from our busy professional lives and get together to spend some family time together. On Nabami of Durga Puja my brother and me went out for a road trip towards northern areas from Bongaigaon. We never saw the Hagrama bridge over Manas River and that was a prime attraction for the trip that day. I was never expecting a bridge so long over Manas. While crossing it I estimated the length to be near half kilometer and while returning calculated it to be more than 1 kilometer though my mind never accepted a bridge length more than a kilometer. later it appeared that the bridge was about one and one third of a kilometer. We went upto Koila Moila which looked like areas of Stone queries that gather stone from riverbeds and supply to nearby towns. However the trip only increased appetite for a longer trip further to the north and the trip to Gelephu came to my mind.

Though the road to Gelephu goes via Gorubhasa near Kasikotra, around 10 kilometer west of Bongaigaon, we tried a different route. We drove north of Bongaigaon through Rowmari and took left before Hagrama bridge towards Kajalgaon-Santiipur road. We drove through Hasraobari and Bengtol to reach Santipur. The road from Hagrama bridge is not a pitched road and can be called an off-routing for passenger vehicles. Neverthless we drove ahead through river sides, villages, paddy fields, forest areas. Roads are mostly good after Hasraobari. Places are yet to be urbanized and therefore the green cover is still there. 

We drove towards north of Bengtal to reach Santipur and towards Deosri. The roads are fantastic and its probable that roads have been repaired recently. Driving north from Santipur through Deosri to reach Hatisar, the populated locality to the Indian side of Indo-Bhutan border at Gelephu. Gelephu is more of a small town compared to Hatisar which can be called a village or small commercial hub.

A tributary to river Manas near Santipur- en route Gelephu

We entered Bhutan after necessary formalities which is minimal for crossing an international border and drove on Gelephu-Trongsa highway for some while. The town, roads looked so neat and people looked so peaceful that it portrays and opposite image of the busy urban city polluted with exhausts of cars, dusts and humming and bustling of a busy city.

Though we wanted to drive further it was getting late and considering the road condition we returned without much expedition inside Bhutan. But the sixty kilometer drive from Bongaigaon to Gelephu was in itself a thrilling experience that I would like to experience again. While returning we decided to drive through Gorubhasa but it was almost a misadventure as the road through Runikhata is so badly dilapidated that driving became miserable. If I drive to Gelephu again in near future, I would surely avoid that road or I would consider taking a big fat SUV.