Showing posts with label bengali poems. Show all posts
Showing posts with label bengali poems. Show all posts

শঙ্খমালা - জীবনানন্দ দাশ


কান্তারের পথ ছেড়ে সন্ধ্যার আঁধারে
সে কে এক নারী এসে ডাকিল আমারে,
বলিল, তােমারে চাই:
বেতের ফলের মতাে নীলাভ ব্যথিত তােমার দুই চোখ
খুঁজেছি নক্ষত্রে আমি—কুয়াশার পাখনায়—
সন্ধ্যার নদীর জলে নামে যে আলােক
জোনাকির দেহ হতে—খুঁজেছি তােমারে সেইখানে—
ধূসর পেঁচার মতাে ডানা মেলে অঘ্রাণের অন্ধকারে
ধানসিড়ি বেয়ে বেয়ে
সােনার সিঁড়ির মতাে ধানে আর ধানে
তােমারে খুঁজেছি আমি নির্জন পেঁচার মতাে প্রাণে।

দেখিলাম দেহ তার বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা;
সন্ধ্যার আঁধারে ভিজে শিরীষের ডালে যেই পাখি দেয় ধরা—
বাঁকা চাঁদ থাকে যার মাথার উপর,
শিঙের মতন বাঁকা নীল চাদ শােনে যার স্বর।

কড়ির মতাে শাদা মুখ তার,
দুইখানা হাত তার হিম;
চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম
চিতা জ্বলে: দখিন শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়
সে আগুনে হায়।

চোখে তার
যেন শত-শতাব্দীর নীল অন্ধকার!
স্তন তার
করুণ শঙ্খের মতাে—দুধে আর্দ্র—কবেকার শঙ্খিনীমালার!
এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।

কুড়ি বছর পরে - জীবনানন্দ দাশ


আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি।
আবার বছর কুড়ি পরে
হয়তাে ধানের ছড়ার পাশে
কার্তিকের মাসে
তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে—তখন হলুদ নদী
নরম নরম হয় শর কাশ হােগলায়—মাঠের ভিতরে।
অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর;
ব্যস্ততা নাইকো আর,
হাঁসের নীড়ের থেকে খড়
পাখির নীড়ের থেকে খড়
ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার—
তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তােমারে আবার!
হয়তাে এসেছে চাদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু সরু কালাে ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের-আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তােমারে নাই মনে!
জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার-
তখন আবার যদি দেখা হয় তােমার আমার!


তখন হয়তাে মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে—
বাবলার গলির অন্ধকারে
অশথের জানালার ফাকে
কোথায় লুকায় আপনাকে?
চোখের পাতার মতাে নেমে চুপি কোথায় চিলের ডানা থামে—
সােনালি সােনালি চিল—শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে
কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তােমারে?

কার্তিকের ভােরে:১৩৪০ - জীবনানন্দ দাশ

কার্তিকের ভােরবেলা কবে
চোখে মুখে চুলের ওপরে
যে শিশির ঝরল তা
শালিক ঝরাল ব’লে ঝরে

আমলকী গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিক
কার্তিকের রােদে আর জলে
আমারই হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন;
সূর্য? না কি সূর্যের চপ্পলে

পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে
পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়
এ জীবনে ঢের শালিক দেখেছি
তবু সেই তিনজন শালিক কোথায়।

আমি যদি হতাম - জীবনানন্দ দাশ

আমি যদি হতাম বনহংস,
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে
ছিপছিপে শরের ভিতর
এক নিরালা নীড়ে;

তাহলে আজ এই ফারুনের রাতে
ঝাউয়েরা শাখার পেছনে চাদ উঠতে দেখে
আমরা নিম্নভূমির জলের গন্ধ ছেড়ে
আকাশের রূপালী শস্যের ভিতর গা ভাসিয়ে দিতাম—

তােমার পাখনায় আমার পালক, আমার পাখনায় তােমার রক্তের স্পন্দন—
নীল আকাশে খই ক্ষেতের সােনালি ফুলের মতাে অজস্র তারা,
শিরীষ বনের সবুজ, রােমশ নীড়ে
সােনার ডিমের মতাে
ফাল্গুনের চাঁদ।
হয়তাে গুলির শব্দ:
আমাদের তির্যক গতিস্রোত,
আমাদের পাখায় পিস্টনের উল্লাস,
আমাদের কণ্ঠে উত্তর হাওয়ার গান।

হয়তাে গুলির শব্দ আবার;
আমাদের স্তব্ধতা,
আমাদের শান্তি।
আজকের জীবনের এই টুকরাে টুকরাে মৃত্যু আর থাকত না;

থাকত না আজকের জীবনের টুকরাে সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

থাকত না আজকের জীবনের টুকরাে সাধের ব্যর্থতা ও অন্ধকার;
আমি যদি বনহংস হতাম;
বনহংসী হতে যদি তুমি;
কোনাে এক দিগন্তের জলসিড়ি নদীর ধারে
ধানক্ষেতের কাছে।

ধান কাটা হয়ে গেছে - জীবনানন্দ দাশ


ধান কাটা হ’য়ে গেছে কবে যেন—ক্ষেতে মাঠে পড়ে আছে খড়
পাতা কুটো ভাঙা ডিম—সাপের খােলস নীড় শীত।
এই সব উৎরায়ে ঐখানে মাঠের ভিতর।
ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ—কেমন নিবিড়।

ঐখানে একজন শুয়ে আছে—দিনরাত দেখা হ’তাে কত কত দিন,
হৃদয়ের খেলা নিয়ে তার কাছে করেছি যে কত অপরাধ;
শান্তি তবু: গভীর সবুজ ঘাস ঘাসের ফড়িং
আজ ঢেকে আছে তার চিন্তা আর জিজ্ঞাসার অন্ধকার স্বাদ।

বুনাে হাঁস - জীবনানন্দ দাশ


পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাদের আহ্বানে

বুনাে হাঁস পাখা মেলে—শাঁই শাঁই শব্দ শুনি তার;
এক- -দুই-তিন–চার—অজস্র—অপার—

রাত্রির কিনারা দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
ইঞ্জিনের মতাে শব্দে; ছুটিতেছে—ছুটিতেছে তারা।

তারপর পড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ—দু একটা কল্পনার হাঁস;

মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়ুক উড়ুক তারা পউষের জ্যোৎস্নায় নীরবে উড়ুক

কল্পনার হাঁস সব— পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রঙ মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তারা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোৎস্নার ভিতর।

বনলতা সেন - জীবনানন্দ দাশ

হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন।


চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।

ডানপিটে - Daanpite - Poems of Sukumar Ray

বাপরে কি ডানপিটে ছেলে ! -
কোন দিন ফাঁসি যাবে নয় যাবে জেলে ।
একটা সে ভূত সেজে আঠা মেখে  মুখে ,
ঠাঁই ঠাঁই শিশি ভাঙে শ্লেট দিয়ে ঠুকে !
অন্যটা হামা দিয়ে আলমারি চড়ে ,
খাট থেকে রাগ ক'রে দুম্ দাম্ পড়ে !

কি মুস্কিল - Ki Muskil - Poems of Sukumar Ray

সব লিখেছে এই কেতাবে দুনিয়ার সব খবর যত ,
সরকারী সব অফিসখানার কোন সাহেবের কদর  কত ।
কেমন ক'রে চাটনি বানায়,  কেমন ক'রে পোলাও করে ,
হরেক রকম মুষ্টিযোগের বিধান লিখছে ফলাও করে 
সাবান কালি দাঁতের মাজন বানাবার সব কায়দা কেতা ,
পূজা পার্বন তিথির হিসাব শ্রাদ্ধবিধি লিখছে হেথা ।
সব লিখেছে , কেবল দেখ পাচ্ছিনেকো লেখা কোথায় -
পাগলা ষাঁড়ে করলে তাড়া কেমন ক'রে ঠেকাব তায় !  

Narad ! Narad ! - নারদ ! নারদ ! - Poems of Sukumar Ray

''হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল শাদা বলছিলি লাল ?
(আর) সেদিন নাকি রাত্রি জুড়ে নাক ডেকেছিস বিশ্রী সুরে ?
(আর) তোদের পোষা বেড়ালগুলো শুচু নাকি বেজায় হলো ?
(আর) এই যে শুনি তোদের বাড়ি কেউ নাকি রাখে না দাড়ি ?
ক্যান রে ব্যাটা ইস্টুপিড ? ঠেঙিয়ে তোরে করবো টিট !''
''চোপড়াও তুমি স্পিকটি নট , মারব রেগে পটাপট -''

Golpo Bola - গল্প বলা - Poems of Sukumar Ray

''এক যে রাজা - থাম না দাদা ,
রাজা নয় সে, রাজ পেয়াদা |''
''তার যে মাতুল'' - ''মাতুল কি সে ? 
সবাই জানে সে তার পিশে |''
''তার ছিল এক ছাগল ছানা '' -
''ছাগলের কি গজায় ডানা ?''
''একদিন তার ছাতের প'রে '' -
''ছাত কোথা হে - টিনের ঘরে ?''

Daare daare droom - দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম - Poems of Sukumar Ray

ছুটছে মটর ঘটর ঘটর ছুটছে গাড়ী জুড়ি ,
ছুটছে লোকে নানান ঝোঁকে করছে হুড়োহুড়ি ;
ছুটছে কত খ্যাপার মতো পড়ছে  কত চাপা ,
সাহেব মেমে থমকে থেমে বলছে 'মামা পাপা ' 
আমরা তবু তবলা ঠুকে গাচ্ছি কেমন তেড়ে 
''দাঁড়ে দাঁড়ে দ্রুম ! দেড়ে দেড়ে দেড়ে !''

Ekushe aain - একুশে আইন - Sukumar Ray

শিব ঠাকুরের আপন দেশে 
আইন  কানুন সর্বনেশে !
কেউ যদি যায় পিছলে পড়ে 
প্যাদা এসে পাকড়ে ধরে ,
কাজীর কাছে হয় বিচার
            একুশ টাকা দণ্ড তার ।।

শিশুর দেহ -Shishur deho - Poems of Sukumar Ray


চশমা-আটা পন্ডিতে কয়, শিশুর দেহ দেখে -
'হাড়ের পরে মাংস গেঁথে , চামড়া দিয়ে ঢেকে,
শিরার  মাঝে রক্ত দিয়ে, ফুসফুসেতে বায়ু,
বাধলো দেহ সুঠাম করে পেশী এবং স্নায়ু ।'
কবি বলেন, 'শিশুর মুখে হেরি তরুণ রবি,
উৎসারিত আনন্দে তার জাগে জগৎ ছবি,

শ্রাবণে - Shrabone - Poems of Sukumar Ray

জল ঝরে, জল ঝরে, সারাদিন সারারাত - 
অফুরান নামতায় বাদলের ধারাপাত 
আকাশের মুখঢাকা, ধোয়ামাখা চারিধার,
পৃথিবীর ছাত পিটে ঝমাঝম বারিধার ।
স্নান করে গাছপালা প্রাণখোলা বরষায় ,
নদীনালা ঘোলাজল ভরে ওঠে ভরসায় ।

গ্রীষ্ম - Grishmo - Poems of Sukumar ray

                      এক 

ওই এল বৈশাখ, ওই নামে গ্রীষ্ম, 
খাই খাই রবে জেনো ভয়ে কাঁপে বিশ্ব !
চোখে যেন দেখি তার ধূলিমাখা অঙ্গ,
বিকট কুটিলজটে ভ্রুকুটির ভঙ্গ,
রোদে রাঙা দুই আঁখি শুকায়েছে কোটরে,
ক্ষুধার আগুন যেন জ্বলে তার জঠরে !
মনে হয় বুঝি তার নিশ্বাসমাত্রে 
তেড়ে আসে পালাজ্বর পৃথিবীর গাত্রে !

বর্ষ গেল, বর্ষ এল - Borsho gelo borsho elo - Poems of Sukumar Ray

বর্ষ গেল, বর্ষ এল, গ্রীষ্ম এলেন বাড়ি,
পৃথ্বী এলেন চক্র দিয়ে এক বছরের পাড়ি ।
সত্যিকালের এই পৃথিবী বয়স কেবা জানে,
লক্ষ হাজার বছর ধরে চলছে একই টানে ।
আপন তালে আকাশ পথে আপনি চলে বেগে 
গ্রীষ্মকালের তপ্ত রোদে বর্ষাকালের মেঘে,
শরৎকালের কান্না হাসি হালকা বাদল হাওয়া,

আয়রে আলো আয় - Aay re aalo aay - Poems of Sukumar Ray

পুব গগনে রাত পোহালো,
ভোরের কোলে লাজুক আলো নয়ন মেলে চায় ।
আকাশতলে ঝলক জ্বলে,
মেঘের শিশু  ছলে আলোক মাখে গায় ।
সোনার আলো,  রঙিন আলো ,
স্বপ্নে আঁকা নবীন আলো - আয়রে আলো আয় ।

মহাভারত - আদিপর্ব - Mahabharat Adiporbo - Poems of Sukumar Ray

হস্তিনায় চন্দ্রবংশ কুরুরাজকুল 
রাজত্ব করেন সুখে বিক্রমে অতুল ।
সেই কূলে জন্ম তবু দৈববশে হায় 
অন্ধ বলি ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য নাহি পায় 
কনিষ্ঠ তাহার পান্ডু, রাজত্ব সে করে,
পাঁচটি সন্তান তার দেবতার বরে ।
জ্যেষ্ঠপুত্র যুধিষ্ঠির ধীর শান্ত মন 
'সাক্ষাৎ ধর্মের পুত্র' কহে সর্বজন ।

ভীষ্ম -Bheesmo - Poems of Sukumar Ray

কুরুকূলে পিতামহ ভীষ্মমহাশয় 
ভুবন বিজয়ী বীর শুন পরিচয় -
শান্তনু রাজার পুত্র নাম সত্যব্রত 
জগতে সার্থক নাম সত্যে অনুরত ।
স্বয়ং জননী গঙ্গা ব দিলা তাঁরে 
নিজ ইচ্ছা বিনা বীর না মরে সংসারে ।