ভুলে
কে আমারে জেনো এনেছে ডাকিয়া, এসেছি ভুলে ।
তবু একবার চাও মুখপানে নয়ন তুলে ।
দেখি, ও নয়নে নিমেষের তরে
সেদিনের ছায়া পরে কি না পড়ে ,
সজল আবেগে আঁখিপাতা দুটি পড়ে কি ঢুলে ।
ক্ষনিকের তরে ভুল ভাঙ্গায়ো না , এসেছে ভুলে ।।
বেলকুঁড়ি দুটি করে ফুটি ফুটি অধর খোলা ।
মনে পরে গেলো সেকালের সেই কুসুম তোলা ।
সেই শুকতারা সেই চোখে চায় ,
বাতাস কাহারে খুঁজিয়া বেড়ায়,
উষা না ফুটিতে হাসি ফুটে তার গগনমূলে ।
সেদিন যে গেছে ভুলে গেছি , তাই এসেছি ভুলে ।।
ব্যাথা দিয়ে কবে কথা কোয়েছিলে পরে না মনে ।
দূরে থেকে কবে ফিরে গিয়েছিলে নাই স্মরণে ।
শুধু মনে পড়ে হাসিমুখখানি ,
লাজে-বাধো -বাধো সোহাগের বাণী,
মনে পড়ে সেই হৃদয় -উছাস নয়নকূলে ।
তুমি যে ভুলেছ ভুলে গেছি, তাই এসেছি ভুলে ।।
কাননের ফুল ের তো ভোলে নি , আমরা ভুলি -
সেই তো ফুটেছে পাতায় পাতায় কামিনীগুলি ।
চাঁপা কথা হতে এনেছে ধরিয়া
অরুণকিরণ কোমল করিয়া -
বকুল ঝরিয়া মরিবারে চায় কাহার চুলে !
কেহ ভোলে কেহ ভোলে না যে, তাই এসেছি ভুলে ।।
এমন করিয়া কেমনে কাটিবে মাধবী রাতি !
দখিনে বাতাসে কেহ নাই পাশে সাথে সাথি ।
চারি দিক হতে বাঁশি শোনা যায় ,
সুখে আছে যারা তারা গান গায় -
আকুল বাতাসে , মদির সুবাসে , বিকচ ফুলে ।
এখনো কি কেঁদে চাহিবে না কেউ, আসিলে ভুলে ?।
বৈশাখ ১২৯৪
ভুল ভাঙা
বুঝেছি আমার নিশার স্বপন হয়েছে ভোর।
মালা ছিল তার ফুলগুলি গেছে , রয়েছে ডোর।
নেই আর সেই চুপি চুপি চাওয়া ,
ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া -
চেয়ে আছে আঁখি , নাই ও আঁখিতে প্রেম ঘোর ।
বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ বাহুতে মোর ।।
হাসিটুকু আর পড়ে না তো ধরা অধরকোণে ।
আপনারে আর চাহ না লুকাতে আপনমনে ।
স্বর শুনে আর উতলা হৃদয়
উথলি উঠে না সারা দেহময় ,
গান শুনে আর ভাসে না নয়নে নয়নলোর ।
আঁখিজলরেখা ঢাকিতে চাহে না শরমচোর ।।
বসন্ত নাহি এ ধরায় আর আগের মতো ,
জ্যোৎস্নাযামিনী যৌবনহারা জীবনহত ।
আর বুঝি কেহ বজায় না বীণা
কে জানে কাননে ফুল ফোটে কি না -
কে জানে সে ফুল তোলে কিনা কেউ ভরি আঁচোর ।
কে জানে সে ফুলে মালা গাঁথে কিনা সারা প্রহর ।।
বাঁশি বেজেছিল , ধরা দিনু যেই থামিল বাঁশি ।
এখন কেবল চরণে শিকল কঠিন ফাঁসি ।
মধুনিশা গেছে , স্মৃতি তারি আজ
মর্মে মর্মে হানিতেছে লাজ -
সুখ গেছে, শুধু আছে প্রাণপণ মিছে আদর ।।
কতই না জানি জেগেছে রজনী করুণ দুঃখে ,
সদয় নয়নে চেয়েছ আমার মলিন মুখে ।
পরদুঃখভার সহে নাক আর ,
লতায়ে পড়িছে দেহ সুকুমার -
তবু আসি আমি , পাষান হৃদয় বড়ো কঠোর ।
ঘুমাও ঘুমাও - আঁখি ঢুলে আসে ঘুমে কাতর ।
কলিকাতা
বৈশাখ , ১২৯৪
বিরহানন্দ
ছিলাম নিশিদিন আশাহীন প্রবাসী
বিরহতপোবনে আনমনে উদাসী ।
আঁধারে আলো মিশে দিশে দিশে খেলিত ,
অটবী বায়ুবশে উঠিত সে উছাসি ।
কখনো ফুল-দুটো আঁখিপুট মেলিত ,
কখনো পাতা ঝ'রে পড়িত রে নিশাসি ।।
তবু সে ছিনু ভালো আধা-আলো আঁধারে ,
গহন শত-ফের বিষাদের মাঝারে।
নয়নে কত ছায়া কত মায়া ভাসিত ,
উদাস বায়ু সে তো ডেকে যেত আমারে।
ভাবনা কত সাজে হৃদিমাঝে অসিত,
খেলাত অবিরত কত শত আকারে ।।
বিরহপরিপূত ছায়াযুত শয়নে
ঘুমের সাথে স্মৃতি আসে নিতি নয়নে।
কপোত-দুটি ডাকে বসি শাখে মধুরে,
দিবস চলে যায় গলে যায় গগনে।
কোকিল কুহুতানে ডেকে আনে বধূরে ,
নিবিড় শীতলতা তরুলতা - গহনে ।।
আকাশে চাহিতাম, গাহিতাম একাকী -
মনের যত কথা ছিল সেথা লেখা কি !
দিবস নিশি ধ'রে ধ্যান ক'রে তাহারে
নীলিমা-পরপার পাবো তার দেখা কি !
তটিনী অনুখন ছোটে কোন পাথারে ,
আমি যে গান গাই তারি ঠাঁই শেখা কি ?।
বিরহে তারি নাম শুনিতাম পবনে ,
তাহারি সাথে থাকা মেঘে ঢাকা ভবনে ।
পাতার মরমর কলেবর হরষে ,
তাহারি পদধ্বনি যেন গণি কাননে ।
মুকুল সুকুমার যেন তার পরশে ,
চাঁদের চোখে ক্ষুধা তারি সুধা স্বপনে ।।
সারাটা দিনমান রচি গান কত-না ,
তাহারি পাশে রহি যেন কহি বেদনা
কানন মরমরে কত স্বরে কহিত ,
ধ্বনিত যেন দিশে তাহারি সে রচনা ।
সতত দূরে কাছে আগে পাছে বহিত
তাহারি যত কথা পাতা লতা ঝরনা ।।
তাহারে আঁকিতাম, রাখিতাম ধরিয়া
বিরহছায়াতল সুশীতল করিয়া ।
কখনো দেখি যেন ম্লান-হেন মুখানি ,
কখনো আঁখিপুটে হাঁসি উঠে ভরিয়া ।
কখনো সারারাত ধরি হাত - দুখানি
রহি গো বেশবাসে কেশপাশে মরিয়া ।।
বিরহ সুমধুর হল দূর কেন রে !
মিলন দাবানলে গেলো জ্বলে যেন রে ।
কই সে দেবী কই ! হেরো ওই একাকার ,
শ্মশানবিলাসিনী বিবাসিনী বিহরে ।
নাই গো দয়ামায়া স্নেহছায়া নাহি আর ।
সকলই করে ধুধু, প্রাণ শুধু শিহরে ।।
[জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৪]
সিন্ধুতরঙ্গ
পুরীতীর্থযাত্রী তরুণীর নিমজ্জন উপলক্ষে
দোলে রে প্রলয় দোলে অকুল সমুদ্র কোলে
উৎসব ভীষণ ।
শত পক্ষ ঝাপটিয়া বেড়াইছে দাপটিয়া
দুর্দম পবন ।
আকাশ সমুদ্র সাথে প্রচন্ড মিলন মাতে
নিখিলের আঁখিপাতে আবরি তিমির ।
বিদ্যুৎ চমকি ত্রাসি , হা হা করে ফেনরাশি ,
তীক্ষ্ণ শ্বেত রুদ্র হাসি জড়প্রকৃতির ।
চক্ষুহীন কর্ণহীন গেহহীন স্নেহহীন
মত্ত দৈত্যগণ
মরিতে ছুটেছে কোথা , ছিড়েছে বন্ধন ।।
হারাইয়া চারি ধার নীলাম্বুধি অন্ধকার
কল্লোলে ক্রন্দনে
রোষে ত্রাসে উর্দ্ধশ্বাসে অট্টরোল অট্টহাসে
উন্মাদগর্জনে
ফাটিয়া ফুটিয়ে উঠে , চূর্ণ হয় যায় টুটে ,
খুঁজিয়া মরিছে ছুটে আপনার কূল –
যেন রে পৃথিবী ফেলি বাসুকি করিছে কেলি
সহস্রৈক ফণা মেলি আচারি লাঙ্গুল ।
যেন রে তরল নিশি টলমল দশ দিশি
উঠেছে নড়িয়া ,
আপন নিদ্রার জাল ফেলেছে ছিঁড়িয়া ।।
নাই সুর , নাই ছন্দ অর্থহীন নিরানন্দ
জড়ের নর্তন ।
সহস্র জীবন বেঁচে ওই কি উঠেছে নেচে
প্রকান্ড মরণ !
জল বাষ্প বজ্র বায়ু লভিয়াছে অন্ধ আয়ু,
নূতন জীবনস্নায়ূ টানিছে হতাশে –
দিগ্বিদিক নাহি জানে , বাধা বিঘ্ন নাহি মানে ,
ছুটেছে প্রলয় পানে আপনারি ত্রাসে ।
হেরো , মাঝখানে তারি আটশত নরনারী
বাহু বাঁধি বুকে
প্রাণে আঁকড়িয়া প্রাণ চাহিয়া সম্মুখে ।।
তরণী ধরিয়া ঝাঁকে রাক্ষসী ঝটিকা হাঁকে
'দাও দাও দাও' ।
সিন্ধু ফেনোচ্ছলছলে কোটি উর্ধকর বলে
'দাও দাও দাও' ।
বিলম্ব দেখিয়া রোষে ফেনায়ে ফেনায়ে ফোঁসে ,
নীল মৃত্যু মহাক্রোশে শ্বেত হয়ে উঠে ।
ক্ষুদ্র তরী গুরু ভার সহিতে পারে না আর
লৌহবক্ষ ওই তার যায় বুঝি টুটে ।
অধ ঊর্ধ্ব এক হয়ে ক্ষুদ্র এ খেলনা লয়ে
খেলিবারে চায় ।
দাঁড়াইয়া কর্ণধার তরীর মাথায় ।।
নরনারী কম্পমান ডাকিতেছে ভগবান ,
হায় ভগবান
'দয়া করো, দয়া করো ' উঠিছে কাতর স্বর ,
'রাখো রাখো প্রাণ '
কথা সেই পুরাতন রবি শশী তারাগণ ,
কথা আপনার ধন ধরণীর কোল !
আজন্মের স্নেহসার কথা সেই ঘরদ্বার –
পিশাচী এ বিমাতার হিংস্র উতরোল !
যে দিকে ফিরিয়া চাই পরিচিত কিছু নাই ,
নাই আপনার –
সহস্র করাল মুখ সহস্র আকার ।।
ফেটেছে ধরণীতল সবেগে উঠিছে জল ,
সিন্ধু মেলে গ্রাস ।
নাই তুমি ভগবান, নাই দয়া নাই প্রাণ –
জড়ের বিলাস ।
ভয় দেখে ভয় পায় , শিশু কাঁদে উভরায়
নিদারুণ 'হায় হায়' থামিল চকিতে ।
নিমেষেই ফুরাইল – কখন জীবন ছিল
কখন জীবন গেল নারিল লখিতে ।
যেন রে একই ঝরে নিভে গেল একত্তরে
শত দীপ-আলো –
চকিতে সহস্র গৃহে আনন্দ ফুরালো ।।
প্রাণহীন এ মত্ততা না জানে পরের ব্যাথা
না জানে আপন ।
এর মাঝে কেন রয় ব্যাথাভরা স্নেহময়
মানবের মন !
মা কেন রে এইখানে , শিশু চায় তার পানে ,
ভাই সে ভায়ের টানে কেন কেন পড়ে বুকে -
মধুর রবির করে কত ভালোবাসা-ভরে
কতদিন খেলা করে কত সুখে দুখে ।
কেন করে টলমল দুটি ছোট অশ্রুজল,
সকরুণ আশা !
দীপশিখাসম কাঁপে ভীত ভালোবাসা ।।
এমন জড়ের কোলে কেমনে নির্ভয়ে দোলে
নিখিলমানব !
সব সুখ সব আশ কেন নাহি করে গ্রাস
মরণদানব !
ওই-যে জন্মের তরে জননী ঝাঁপিয়ে পড়ে ,
কেন বাঁধে বক্ষোপরে সন্তান আপন !
মরণের মুখে ধায় সেথাও দিবে না তায় ,
করিয়া রাখিতে চায় হৃদয়ের ধন ।
আকাশেতে পারাবারে দাঁড়ায়েছে এক ধারে ,
এক ধারে নারী -
দুর্বল শিশুটি তার কে লইবে কাড়ি ।।
এ বল কোথায় পেলে – আপন কোলের ছেলে
এত করে টানে !
এ নিষ্ঠুর জড়স্রোতে প্রেম এল কোথা হতে
মানবের প্রাণে !
নৈরাশ্য কভু না জানে , বিপত্তি কিছু না মানে
অপূর্ব অমৃত পানে অনন্ত নবীন –
এমন মায়ের প্রাণ যে বিশ্বের কোনোখান
তিলেক পেয়েছে স্থান , সে কি মাতৃহীন ?
এ প্রলয়-মাঝখানে অবলা জননী-প্রাণে
স্নেহ মৃত্যুজয়ী -
এ স্নেহ রাখে কোন স্নেহময়ী ?।
পাশাপাশি এক ঠাঁই দয়া আছে, দয়া নাই –
বিষম সংশয় ।
মহাশংকা মহা-আশা একত্র বেঁধেছে বাসা,
এক সাথে রয় ।
কেবা সত্য কেবা মিছে নিশিদিন আকুলিছে –
কভু উর্ধে কভু নিচে টানিছে হৃদয় ।
জড়দৈত্য শক্তি হানে, মিনতি নাহিকো মানে –
প্রেম এসে কোলে টানে, দূর করে ভয় ।
এ কি দুই দেবতার দ্যূত খেলা অনিবার
ভাঙাগড়াময় –
চিরদিন অন্তহীন জয় পরাজয় ?।
নিষ্ফল কামনা
রবি অস্ত যায় ।
অরণ্যেতে অন্ধকার আকাশেতে আলো
সন্ধ্যা নত -আঁখি
ধীরে আসে দিবার পশ্চাতে ।
বহে কি না বহে
বিদায়বিষাদশ্রান্ত সন্ধ্যার বাতাস ।
দুটি হাতে হাত দিয়ে ক্ষুধার্ত নয়নে
চেয়ে আছি দুটি-আঁখি-মাঝে ।।
খুঁজিতেছি কোথা তুমি !
যে অমৃত লুকানো তোমায়
সে কোথায় !
অন্ধকার সন্ধ্যার আকাশে
বিজন তারার মাঝে কাঁপিছে যেমন
স্বর্গের আলোকময় রহস্য অসীম ,
ওই নয়নের
নিবিড়তিমিরতলে কাঁপিছে তেমনি
আত্মার রহস্যশিখা ।
তাই চেয়ে আছি ।
প্রাণ মন সব লয়ে তাই ডুবিতেছি
অতল আকাঙ্খাপারাবারে ।
তোমার আঁখির মাঝে,
হাসির আড়ালে ,
বচনের সুধাস্রোতে ,
তোমার বদনব্যাপী
করুণশান্তির তলে
তোমারে কোথায় পাব -
তাই এ ক্রন্দন ।।
বৃথা এ ক্রন্দন ।
হায় রে দুরাশা -
এ রহস্য, এ আনন্দ তোর তরে নয় ।
যাহা পাস তাই ভালো -
হাসিটুকু , কথাটুকু ,
নয়নের দৃষ্টিটুকু, প্রেমের আভাস ।
সমগ্র মানব তুই পেতে চাস ,
এ কী দুঃসাহস !
কি আছে বা তোর !
কী পারিবি দিতে !
আছে কি অনন্ত প্রেম ?
পারিবি মিটাতে
জীবনের অনন্ত অভাব ?
মহাকাশ - ভরা
এ অসীম জগৎ-জনতা,
এ নিবিড় আলো-অন্ধকার ,
কোটি ছায়াপথ , মায়াপথ ,
দুর্গম উদয় -অস্তাচল –
এরই মাঝে পথ করি
পারিবি কি নিয়ে যেতে
চিরসহচরে
চিররাত্রিদিন
একা অসহায় ?
যে জন আপনি ভীত , কাতর দুর্বল ,
ম্লান, ক্ষুধাতৃষাতুর, অন্ধ, দিশাহারা ,
আপন হৃদয়ভারে পীড়িত জর্জর ,
সে কাহারে পেতে চায় চিরদিন-তরে !
ক্ষুধা মিটাবার খাদ্য নহে যে মানব ,
কেহ নহে তোমার আমার ।
অতি সযতনে
অতি সংগোপনে ,
সুখে দুঃখে, নিশীথে দিবসে
বিপদে সম্পদে
জীবনে মরণে ,
শত ঋতু আবর্তনে
শতদল উঠিতেছে ফুটি -
সুতীক্ষ্ন বাসনা-ছুরি দিয়ে
তুমি তাহা চাও ছিঁড়ে নিতে ?
লও তার মধুর সৌরভ ,
দেখো তার সৌন্দর্যবিকাশ ,
মধু তার কারো তুমি পান ,
ভালোবাসো , প্রেমে হও বলী -
চেয়ো না তাহারে ।
আকাঙ্খার ধন নহে আত্মা মানবের ।।
শান্ত সন্ধ্যা , স্তব্ধ কোলাহল ।
নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে ।
চলো ধীরে ঘরে ফিরে যাই ।।
১৩ অগ্রহায়ণ ১২৯৪
নারীর উক্তি
মিছে তর্ক – থাক তবে থাক,
কেন কাঁদি বুঝিতে পার না ?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই মুছিলাম আঁখি ,
এ শুধু চোখের জল , এ নহে ভর্ৎসনা ।।
আমি কি চেয়েছি পায়ে ধরে
ওই তব আঁখি তুলে চাওয়া ,
ওই কথা , ওই হাঁসি ওই কাছে আসা-আসি,
অলক দুলায়ে দিয়ে হেসে চলে যাওয়া ?।
কেন আন বসন্ত নিশীথে
আঁখিভরা আবেশ বিহ্ব্ল
যদি বসন্তের শেষে শ্রান্তমনে ম্লান হেসে
কাতরে খুঁজিতে হয় বিদায়ের ছল ?।
আছি যেন সোনার খাঁচায়
একখানি পোষ মানা প্রাণ ।
এও কি বুঝাতে হয় – প্রেম যদি নাহি রয়
হাসিয়ে সোহাগ করা শুধু অপমান ।।
মনে আছে, সেই একদিন
প্রথম প্রণয় সে তখন ।
বিমল শরৎকাল, শুভ্র ক্ষীণ মেঘজাল,
মৃদু শীতবায়ে স্নিগ্ধ রবির কিরণ ।।
কাননে ফুটিত শেফালিকা,
ফুলে ছেয়ে যেত তরুমূল –
পরিপূর্ণ সুরধুনী, কুলুকুলু ধ্বনি শুনি –
পরপারে বনশ্রেণী কুয়াশা-আকুল ।।
আমা-পানে চাহিয়ে তোমার
আঁখিতে কাঁপিত প্রাণখানি ।
আনন্দে-বিষাদে মেশা সেই নয়নের নেশা
তুমি তো জানো না তাহা, আমি তাহা জানি ।।
সে কি মনে পড়িবে তোমার –
সহস্র লোকের মাঝখানে
যেমনি দেখিতে মোরে কোন আকর্ষণ-ডোরে
আপনি আসিতে কাছে জ্ঞানে কি অজ্ঞানে ।।
ক্ষণিক বিরহ-অবসানে
নিবিড় মিলনব্যাকুলতা –
মাঝে মাঝে সব ফেলি রহিতে নয়ন মেলি,
আঁখিতে শুনিতে যেন হৃদয়ের কথা ।।
কোনো কথা না রহিলে তবু
শুধাইতে নিকটে আসিয়া ।
নীরবে চরণ ফেলে চুপি চুপি কাছে এলে
কেমনে জানিতে পেতে, ফিরিতে হাসিয়া ।।
আজ তুমি দেখেও দেখ না
সব কথা শুনিতে না পাও ।
কাছে আস আশা ক'রে আছি সারা দিন ধরে ,
আনমনে পাশ দিয়ে তুমি চলে যাও ।।
দীপ জ্বেলে দীর্ঘ ছায়া লয়ে
বসে আছি সন্ধ্যায় ক'জনা ,
হয়তো বা কাছে এস , হয়তো বা দূরে বস,
সে-সকলই ইচ্ছাহীন দৈবের ঘটনা ।।
এখন হয়েছে বহু কাজ ,
সতত রয়েছে অন্যমনে ।
সর্বত্র ছিলাম আমি, এখন এসেছি নামি –
হৃদয়ের প্রান্তদেশে , ক্ষুদ্র গৃহকোণে ।।
দিয়েছিলে হৃদয় যখন
পেয়েছিলে প্রাণমন দেহ ।
আজ সে হৃদয় নাই , যতই সোহাগ পাই
শুধু তাই অবিশ্বাস বিষাদ সন্দেহ ।।
জীবনের বসন্ত যাহারে
ভালোবেসেছিলে একদিন ,
হায় হায় কি কুগ্রহ, আজ তারে অনুগ্রহ !
মিষ্ট কথা দিবে তারে গুটিদুই-তিন ।।
অপবিত্র ও করপরশ
সঙ্গে ওর হৃদয় নহিলে ।
মনে কি করেছ, বঁধু, ও হাসি এতই মধু
প্রেম না দিলেও চলে শুধু হাসি দিলে ?
তুমিই তো দেখলে আমায়
(স্বপ্নেও ছিল না এতো আশা )
প্রেম দেয় কতখানি – কোন হাসি, কোন বাণী ,
হৃদয় বাসিতে পারে কত ভালোবাসা ।।
তোমারি সে ভালোবাসা দিয়ে
বুঝেছি আজি এ ভালোবাসা –
আজি এই দৃষ্টি হাসি, এ আদর রাশি রাশি ,
এই দূরে চলে যাওয়া , এই কাছে আসা ।।
বুক ফেটে কেন অশ্রু পড়ে
তবুও কি বুঝিতে পারো না ?
তর্কেতে বুঝিবে তা কি ? এই মুছিলাম আঁখি –
এ শুধু চিখের জল , এ নহে ভর্ৎসনা ।।
২১ অগ্রহায়ণ, ১২৯৪
পুরুষের উক্তি
বধূ
ব্যক্ত প্রেম
গুপ্ত প্রেম
অপেক্ষা
সুরদাসের প্ৰাৰ্থনা
ভৈরবী
বর্ষার দিনে (Borshaar Dine)
In a rainy day
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বারিষায় -
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায় ।।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর
নিভৃত নির্জন ক্যারি ধার।
দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী ,
আকাশে জল ঝরে অনিবার -
জগতে কেহ যেন নাহি আর ।।
সমাজ সংসার মিছে সব
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি-অনুভব -
আঁধারে মিশে গেছে আর সব ।।
বলিতে ব্যথিবে না নিজ কান,
চমকি উঠিবে না নিজ প্রাণ ।
সেকথা আঁখিনীরে মিশিয়ে যাবে ধীরে ধীরে
বদলবায়ে তার অবসান -
সে কথা ছেয়ে দিবে দুটি প্রাণ ।।
তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার !
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দুকথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার ।।
আছে তো তার পরে বারো মাস -
উঠিবে কত কথা, কত হাস।
আসিবে কত লোক, কত-না দুঃখশোক ,
সেকথা কোনখানে পাবে নাশ -
জগৎ চলে যাবে বারো মাস ।।
ব্যাকুল বেগে আজি বহে বায় ,
বিজুলি থেকে থেকে চমকায়।
যে কথা এ জীবনে রহিয়া গেল মনে
সে কথা আজি যেন বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায় ।।
রোজ ব্যাঙ্ক । খিরকি
৩ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৬
অনন্ত প্রেম
তোমারেই যেন ভালো বসিয়াছি শতরূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার
চিরকাল ধরে হৃদয় গাঁথিয়াছে গীতহার -
কতরূপ ধরে পড়েছি গলায়, নিয়েছ সে উপহার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার ।।
যত শুনি সেই অতীত কাহিনী , প্রাচীন প্রেমের ব্যাথা ,
অতি পুরাতন বিরহমিলন কথা ,
অসীম অতীতে চাহিতে চাহিতে দেখা দেয় অবশেষে
কালের তিমিররজনী ভেদিয়া তোমারি মুরতি এসে
চিরস্মৃতিময়ী ধ্রুবতারকার বেশে ।।
আমরা দুজনে ভাসিয়া এসেছি যুগলপ্রেমের স্রোতে
অনাদি কালের হৃদয় উৎস হতে ।
বিরহ মধুর নয়নসলিলে , মিলন মধুর লাজে -
পুরাতন প্রেম নিত্যনতুন সাজে ।।
আজি সে চির দিবসের প্রেম অবসান লভিয়াছে ,
রাশি রাশি হয়ে তোমার পায়ের কাছে ।
নিখিলের সুখ , নিখিলের দুঃখ , নিখিল প্রাণের প্রীতি ,
একটি প্রেমের মাঝারে মিশেছে সকল স্মৃতি -
সকল কালের সকল কবির গীতি ।।
জোড়াসাঁকো , কলিকাতা
২ ভাদ্র , ১২৯৬
ক্ষণিক মিলন
একদা এলোচুলে কোন ভুলে ভুলিয়া
আসিল সে আমার ভাঙা দ্বার খুলিয়া ।
জ্যোৎস্না অনিমিখ , চারিধার সুবিজন –
চাহিল একবার আঁখি তার তুলিয়া ।
দখিন বায়ু - ভরে থরথরে কাঁপে বন ,
উঠিল প্রাণ মম তারই সম দুলিয়া ।।
আবার ধীরে ধীরে গেল ফিরে আলসে ,
আমার সব হিয়া মাড়াইয়া গেল সে ।
আমার যাহা ছিল সব নিল আপনায় ,
হরিল আমাদের আকাশের আলো সে ।
সহসা এ জগৎ ছায়াবৎ হয়ে যায়
তাহারি চরণের শরণের লালসে ।।
যে জন চলিয়াছে তারই পাছে সব ধায় ,
নিখিলে যত প্রাণ যত গান ঘিরে তায় ।
সকল রূপহার উপহার চরণে –
ধায় গো উদাসিয়া যত হিয়া পায় পায় ।
যে জন পরে থাকে একা ডাকে মরণে –
সুদূর হতে হাসি আর বাঁশি শোনা যায় ।।
[জোড়াসাঁকো, কলিকাতা
৯ ভাদ্র ১২]
ভাল করে বলে যাও
ওগো , ভালো করে বলে যাও ।
বাঁশরী বাজায়ে যে কথা জানাতে সে কথা বুঝায়ে দাও ।
যদি না বলিবে কিছু তবে কেন এসে মুখপানে শুধু চাও ।।
আজি অন্ধতামসী নিশি ।
মেঘের আড়ালে গগনের তারা সবগুলি গেছে মিশি ।
শুধু বাদলের বায় করি হায় -হায় আকুলিছে দশ দিশি ।।
আমি কুন্তল দিব খুলে ।
অঞ্চলমাঝে ঢাকিব তোমায় নিশীথনিবিড় চুলে ।
দুটি বাহুপাশে বাঁধি নত মুখখানি বক্ষে লইব তুলে ।।
সেথা নিভৃতনিলয় সুখে
আপনার মনে বলে যেয়ো কথা মিলনমুদিত বুকে ।
আমি নয়ন মুদিয়া শুনিব কেবল, চাহিব না মুখে মুখে ।।
যবে ফুরাবে তোমার কথা
যে যেমন আছি রহিব বসিয়া চিত্র পুতলি যথা
শুধু শিয়রে দাঁড়ায়ে করে কানাকানি মর্মর তরুলতা ।।
শেষে রজনীর অবসানে
অরুণ উদিলে ক্ষনেকের তরে চাব দুঁহু দোহা-পানে ।
ধীরে ঘরে যাব ফিরে দোঁহে দুই পথে জলভরা দুনয়ানে ।।
তবে ভালো করে বলে যাও ।
আঁখিতে বাঁশিতে যে কথা ভাষিতে সে কথা বুঝায়ে দাও ।
শুধু কম্পিত সুরে আধো ভাষা পুরে কেন এসে গান গাও ।।
[শান্তিনিকেতন, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭ ]
মেঘদূত
কবিবর , কবে কোন বিস্মৃত বরষে
কোন পুন্য আষাঢ়ের প্রথম দিবসে
লিখেছিলে মেঘদূত ! মেঘমন্দ্র শ্লোক
বিশ্বের বিরহী যত সকলের শোক
রাখিয়াছে আপন আধার স্তরে স্তরে
সঘনসংগীতমাঝে পুঞ্জীভূত করে ।।
সেদিন সে উজ্জয়িনীপ্রাসাদশিখরে
কী না জানি ঘনঘটা , বিদ্যুৎ-উৎসব ,
উদ্দাম পবনবেগ , গুরুগুরু রব !
গম্ভীর নির্ঘোষ সেই মেঘসংঘর্ষের
জাগায়ে তুলিয়াছিল সহস্র বর্ষের
অন্তরগূঢ় বাষ্পাকুল বিচ্ছেদক্রন্দন
এক দিনে। ছিন্ন করি কালের বন্ধন
সেই দিন ঝরে পড়েছিল অবিরল
চিরদিবসের যেন রুদ্ধ অশ্রুজল
আর্দ্র করি তোমার উদার শ্লোকরাশি ।।
সেদিন কি জগতের যতেক প্রবাসী
জোড়হস্তে মেঘপানে শূন্যে তুলি মাথা
গেয়েছিল সমস্বরে বিরহের গাথা
ফিরি প্রিয়গৃহ-পানে ? বন্ধনবিহীন
নবমেঘপক্ষ -' পরে করিয়া আসীন
পাঠাতে চাহিয়াছিল প্রেমের বারতা
অশ্রুবাষ্প-ভরা - দূর বাতায়নে যথা
বিরোহিণী ছিল শুয়ে ভূতল-শয়নে
মুক্তকেশে, স্নানবেশে, সজলনয়নে ?।
তাদের সবার গান তোমার সংগীতে
পাঠায়ে কি দিলে, কবি, দিবসে নিশীথে
দেশে দেশান্তরে খুঁজি বিরহিনী প্রিয়া ?
শ্রাবনে জাহ্নবী যথা যায় প্রবাহিয়া
টানি লয়ে দিশ -দিশান্তরে বারিধারা
মহাসমুদ্রের মাঝে হতো দিশাহারা।
পাষানশৃঙ্খলে যথা বন্দী হিমাচল
আষাঢ়ে অনন্ত শুন্যে হেরি মেঘদল
স্বাধীন , গগনচারী , কাতরে নিশ্বাসি
সহস্র কন্দর হতে বাস্প রাশি রাশি
পাঠায় গগন-পানে। ধায় তারা ছুটি
উধাও কামনা সম , শিখরেতে উঠি
সকলে মিলিয়া শেষে হয় একাকার ,
সমস্ত গগনতল করে অধিকার ।।
সেদিনের পরে গেছে কত শতবার
প্রথম দিবস স্নিগ্ধ নববরষার।
প্রতি বর্ষা দিয়ে গেছে নবীন জীবন
তোমার কাব্যের 'পরে করি বরিষণ
নববৃষ্টিবারিধারা , করিয়া বিস্তার
নবঘনস্নিগ্ধচ্ছায়া, করিয়া সঞ্চার
নব নব প্রতিধ্বনি জলদমন্দ্রের ,
স্ফীত করি স্রোতোবেগে তোমার ছন্দের
বর্ষাতরঙ্গিণীসম ।।
কত কাল ধ'রে
কত সঙ্গীহীন জন প্রিয়াহীন ঘরে
বৃষ্টিক্লান্ত বহুদীর্ঘ লুপ্ততারাশশী
আষাঢ়সন্ধ্যায়, ক্ষীণ দীপালোকে বসি
ওই ছন্দ মন্দ মন্দ করি উচ্চারণ
নিমগ্ন করেছে নিজ বিজনবেদন।
সে-সবার কণ্ঠস্বর করনে আসে মম
সমুদ্রের তরঙ্গের কলধ্বনি-সম
তব কাব্য হতে ।।
ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আছি সেই শ্যামবঙ্গদেশে
যেথা জয়দেব কবি কোন বর্ষাদিনে
দেখেছিলা দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া , পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর ।।
আজি অন্ধকার দিবা , বৃষ্টি ঝরঝর ,
দুরন্ত পবন অতি - আক্রমণে তার
অরণ্য উদ্যতবাহু করে হাহাকার।
বিদ্যুৎ দিতেছে উঁকি ছিঁড়ি মেঘভার
খরতর বক্র হাসি শূন্যে বরষিয়া ।।
অন্ধকার রুদ্ধগৃহে একেলা বসিয়া
পরিতেছি মেঘদূত। গৃহত্যাগী মন
মুক্তগতি মেঘপৃষ্ঠে লয়েছে আসন ,
উড়িয়াছে দেশদেশান্তরে। কোথা আছে
সানুমন আম্রকুট , কোথা বহিয়াছে
বিমল বিশীর্ণ রেবা বিন্ধপদমূলে
উপলব্যথিতগতি, বেত্রবতীকূলে
পরিণতফলশ্যামজম্বুবনচ্ছায়ে
কোথায় দর্শাণ গ্রাম রয়েছে লুকায়ে
প্রস্ফুটিত কেতকীর বেড়া দিয়ে ঘেরা,
পথতরুশাখে কোথা গ্রামবিহঙ্গেরা
বর্ষায় বাঁধিছে নীড় কলরবে ঘিরে
বনস্পতি ! না জানি সে কোন নদীতীরে
যুথীবনবিহারিণী বনাঙ্গনা ফিরে ,
তপ্ত কপোলের তাপে তপ্ত কর্ণৎপল
মেঘের ছায়ার হতেছে বিকল।
ভ্রুবিলাসে শেখে নাই করা সেই নারী
জনপদবধূজন গগনে নেহারি
ঘনঘটা , উর্দ্ধনেত্রে চাহে মেঘ-পানে ;
ঘননীল ছায়া পড়ে সুনীল নয়ানে !
কোন মেঘশ্যামশৈলে মুগ্ধ সিদ্ধাঙ্গনা
স্নিগ্ধ নবঘন দেখি আছিল উন্মনা
শিলাতলে ; সহসা আসিতে মহা ঝড়
চকিত চকিত হয়ে ভয়ে জড়সড়
সম্বরি বসন ফিরে গুহাশ্রয় খুঁজি ,
বলে, মা গো , গিরিশৃঙ্গ উড়াইল বুঝি !
কোথায় অবন্তিপুরী , নির্বিন্ধ্যা তটিনী ,
কোথা শিপ্রানদীনীরে হেরে উজ্জয়িনী
স্বমহিমাচ্ছায়া ! সেথা নিশি দ্বিপ্রহরে
প্রণয়চাঞ্চল্য ভুলি ভবনশিখরে
সুপ্ত পারাবত ; শুধু বিরহবিকারে
রমণী বাহির হয় প্রেম-অভিসারে
সূচীভেদ্য অন্ধকারে রাজপথমাঝে
ক্কচ্চিৎবিদ্যুৎলোকে। কথা সে বিরাজে
ব্রহ্মাবর্তে কুরুক্ষেত্র ! কথা কনখল ,
যেথা সেই জহ্নুকন্যা যৌবনচঞ্চল
গৌরির ভ্রুকুটিভঙ্গি করি অবহেলা
ফেনপরিহাসচ্ছলে করিতেছে খেলা
লয়ে ধুর্জটির জটা চন্দ্রকরজ্জ্বল ।।
এইমতো মেঘরূপে ফিরি দেশে দেশে
হৃদয় ভাসিয়া চলে উত্তরিতে শেষে
কামনার মোক্ষধাম অলকার মাঝে ,
বিরহিনী প্রিয়তমা যেথায় বিরাজে
সৌন্দর্যের আদিসৃষ্টি। সেথা কে পারিত
লয়ে যেতে তুমি ছাড়া করি অবারিত
লক্ষীর বিলাসপুরী - ভুবনে !
অনন্ত বসন্তে যেথা নিত্য পুষ্পবনে
নিত্য চন্দ্রালোকে , ইন্দ্রনীল শৈলমূলে
সুবর্ণসরোজফুল্ল সরোবরকুলে ,
মনিহর্ম্যে অসীম সম্পদে নিমগনা
কাঁদিতেছে একাকিনী বিরহবেদনা।
মুক্ত বাতায়ন হতে যায় তারে দেখা -
শয্যাপ্রান্তে লীণতনু ক্ষীণশশীরেখা
পূর্বগগনের মুলে যেন অস্তপ্রায়।
কবি, তব মন্ত্রে আজি মুক্ত হয়ে যায়
রুদ্ধ এই হৃদয়ের বন্ধনের ব্যাথা।
লভিয়াছি বিরহের স্বর্গলোক , যেথা
চিরনিশি যাপিতেছে বিরহিনী প্রিয়া
অনন্তসৌন্দর্য-মাঝে একাকী জাগিয়া ।।
আবার হারায়ে যায়; হেরি, চারি ধার
বৃষ্টি পরে অবিশ্রাম। ঘনায়ে আঁধার
আসিছে নির্জন নিশা। প্রান্তরের শেষে
কেঁদে চলিয়াছে বায়ু অকূল -উদ্দেশে।
ভাবিতেছি অর্ধরাত্রি অনিদ্রানয়ান -
কে দিয়েছে হেন শাপ , কেন ব্যবধান ?
কেন ঊর্ধ্বে চেয়ে কাঁদে রুদ্ধ মনোরথ ?
কেন প্রেম আপনার নাহি পে পথ ?
সশরীরে কোন নর গেছে সেইখানে ,
মানসসরসীতীরে বিরহশয়ানে ,
রবিহীন মণিদ্বীপ্ত প্রদোষের দেশে
জগতের নদী গিরি সকলের শেষে !
অহল্যার প্রতি
কি স্বপ্নে কাটালে তুমি দীর্ঘ দিবানিশি ,
অহল্যা , পাষাণরূপে ধরাতলে মিশি
নির্বাপিত-হোম-অগ্নি তাপসবিহীন
শূন্য তপোবনচ্ছায়ে ! আছিলে বিলীন
বৃহৎ পৃথীর সাথে হয়ে একদেহ,
তখন কি জেনেছিলে তার মহাস্নেহ ?
ছিল কি পাষাণতলে অস্পষ্ট চেতনা ?
জীবধাত্রী জননীর বিপুল বেদনা বিপুল বেদনা
মাতৃধৈর্যে মৌন মূক সুখ দুঃখ যত
অনুভব করেছিলে স্বপ্নের মতো
সুপ্ত আত্মা মাঝে ? দিবারাত্রি অহরহ
লক্ষকোটি পরানির মিলন-কলহ –
আনন্দবিষাদক্ষুব্ধ ক্রন্দন গর্জন ,
অযুত পান্থের পদধ্বনি অনুক্ষন
পশিত কি অভিশাপনিদ্রা ভেদ ক'রে
কর্ণে তোর – জাগাইয়া রাখিত কি তোরে
নেত্রহীন মূঢ় রূঢ় অর্ধজাগরণে ?।
বুঝিতে কি পেরেছিলে আপনার মনে
নিত্য নিদ্রাহীন ব্যাথা মহাজননীর ?
যেদিন বহিত নব বসন্তসমীর
ধরণীর সর্বাঙ্গের পুলকপ্রবাহ
স্পর্শ কি করিত তোরে ? জীবন-উৎসাহ
ছুটিত সহস্রপথে মরুদিগ্বিজয়ে
সহস্র আকারে , উঠিত সে ক্ষুব্ধ হয়ে
তোমার পাষান ঘেরি করিতে নিপাত
অনুর্বরা -অভিশাপ তব ; সে আঘাত
জাগাত কি জীবনের কম্প তবে দেহে ?।
যামিনী অসিত যবে মানবের গেহে
ধরণী লইত টানি শ্রান্ত তণুগুলি ।
আপনার বক্ষ-'পরে । দুঃখ শ্রম ভুলি
ঘুমাত অসংখ জীব - জাগিত আকাশ –
তাদের শিথিল অঙ্গ , সুষুপ্ত নিশ্বাস
বিভোর কোরিয়া দিত ধরণীর বুক ।
মাতৃঅঙ্গে সেই কোটিজীবস্পর্শসুখ
কিছু তার পেয়েছিলে আপনার মাঝে ?
যে গোপন অন্তঃপুরে জননী বিরাজে –
বিচিত্রিত যবনিকা পত্রপুষ্পজালে
বিবিধ বর্ণের লেখা , তারি অন্তরালে
রহিয়া অসূর্য্যম্পশ্য নিত্য চুপে চুপে
ভরিছ সন্তানগৃহ ধনধান্যরূপে
জীবনে যৌবনে – সেই গূঢ় মাতৃকক্ষে
সুপ্ত ছিলে এতকাল ধরণীর বক্ষে
চিররাত্রি সুশীতল বিস্মৃতি আলয়ে –
যেথায় অন্তকাল ঘুমায় নির্ভয়ে
লক্ষ জীবনের ক্লান্তি ধুলির শয্যায় ,
নিমেষে নিমেষে যেথা ঝ'রে প'ড়ে যায়
দিবাটাপে শুষ্ক ফুল , দগ্ধ উল্কা তারা ,
জীর্ন কীর্তি , শ্রান্ত সুখ , দুঃখ দাহতারা ।।
সেথা স্নিগ্ধ হস্ত দিয়ে পাপতাপরেখা
মুছিয়া দিয়েছে মাতা । দিলে আজি দেখা
ধরণীর সদ্যজাত কুমারীর মতো
সুন্দর সরল শুভ্র । হয়ে বাক্যহত
চেয়ে আছো প্রভাতের জগতের পানে ।
যে শিশির পড়েছিল তোমার পাষাণে
রাত্রিবেলা , এখন সে কাঁপিছে উল্লাসে
আজানুচুম্বিত মুক্ত কৃষ্ণ কেশপাশে ।
যে শৈবাল রেখেছিল ঢাকিয়া তোমায়
ধরণীর শ্যামশোভা অঞ্চলের প্রায়
বহুবর্ষ হতে, পেয়ে বহু বর্ষাধারা
সতেজ সরস ঘন, এখনো তাহারা
লগ্ন হয়ে আছে তব নগ্ন গৌড় দেহে
মাতৃদত্ত বস্ত্রখানি সুকোমল স্নেহে ।।
হাসে পরিচিতি হাসি নিখিল সংসার ।
তুমি চেয়ে নির্নিমেষ । হৃদয় তোমার
কোন দূর কালক্ষেত্রে চলে গেছে একা
আপনার ধূলিলুপ্ত পদচিহ্নরেখা
পদে পদে চিনে চিনে । দেখিতে দেখিতে
চারি দিক হতে সব এল চারি ভিতে
জগতের পূর্ব পরিচয় । কৌতূহলে
সমস্ত সংসার ওই এল দলে দলে
সম্মুখে তোমার ; থিম গেল কাছে এসে
চমকিয়া । বিস্ময়ে রহিল অনিমেষে ।।
অপূর্ব রহস্যময়ী মূর্তি বিবসন ,
নবীন শৈশবে স্নাত সম্পূর্ণ যৌবন –
পূর্ণস্ফুট পুস্প যথা শ্যামপত্রপুটে
শৈশবে যৌবনে মিশে উঠিয়াছে ফুটে
এক বৃন্তে । বিস্মৃতিসাগর - নীলনীরে
প্রথম ঊষার মতো উঠিয়াছ ধীরে ।
তুমি বিশ্বপানে চেয়ে মানিছ বিস্ময় ,
বিশ্ব তোমাপানে চেয়ে কথা নাহি কয় –
দোঁহে মুখোমুখি । অপাররহস্যতীরে
চিরপরিচয়মাঝে নব পরিচয় ।।
শান্তিনিকেতন, ১১/১২ জ্যৈষ্ঠ ১২৯৭
আমার সুখ
তুমি কি করেছো মনে দেখেছো পেয়েছো তুমি
সীমারেখা মম ?
ফেলিয়া দিয়াছ মোরে আদি অন্ত শেষ ক'রে
পড়া পুঁথি সম ?
নাই সীমা আগে পাছে, যত চাও তত আছে,
যতই আসিবে কাছে তত পাবে মোরে।
আমারেও দিয়ে তুমি এ বিপুল বিশ্বভুমি
এ আকাশ এ বাতাস দিতে পারো ভ'রে ।
আমাতেও স্থান পেত অবাধে সমস্ত তব
জীবনের আশা ।
একবার ভেবে দেখো এ পরানে ধরিয়াছে
কত ভালোবাসা ।।
সহসা কি শুভক্ষণে অসীম হৃদয়রাশি
দৈবে পড়ে চোখে !
দেখিতে পায়নি যদি দেখিতে পাবে না আর ,
মিছে মরি ব'কে ।
আমি যা পেয়েছি তাই সাথে নিয়ে ভেসে যাই ,
কোনো খানে সীমা নাই ও মধু মুখের।
শুধু স্বপ্ন শুধু স্মৃতি, তাই নিয়ে থাকি নিতি -
আর আশা নাহি রাখি সুখের দুঃখের ।
আমি যাহা দেখিয়াছি আমি যাহা পাইয়াছি
এ জনম-সই
জীবনের সব শুন্য আমি যাহে ভরিয়াছি
তোমার তা কই !
লোহিত সমুদ্র, ১২ কার্তিক ১২৯৭