জনারণ্য
মধ্যাহ্নে নগর মাঝে পথ হতে পথে
কর্মবন্যা ধায় যবে উচ্ছলিত স্রোতে
শত শাখা প্রশাখায় নগরের নাড়ী
উঠে স্ফীত তপ্ত হয়ে, নাচে সে আছাড়ি
পাষাণভিত্তির 'পরে - চৌদিক আকুলি
ধায় পান্থ, ছুটে রথ , উড়ে শুস্ক ধূলি –
তখন সহসা হেরি মুদিয়া নয়ন
মহাজনারণ্য-মাঝে অনন্ত নির্জন
তোমার আসনখানি, কোলাহল মাঝে
তোমার নিঃশব্দ সভা নিস্তব্ধে বিরাজে ।
সব দুঃখে , সব সুখে , সব ঘরে ঘরে ,
সব চিত্তে সব চিন্তা সব চেষ্টা- 'পরে
যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু যায় দেখা ,
হে সঙ্গবিহীন দেব , তুমি বসি একা ।।
স্তব্ধতা
আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে ।
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি । ক্ষীণ নদীরেখা
নাহি করে গান আজি , নাহি লেখে লেখা
বালুকার তটে । দূরে দূরে পল্লী যত
মুদ্রিত নয়নে রৌদ্র পোহাইতে রত ,
নিদ্রায় অলস, ক্লান্ত ।।
এই স্তব্ধতায়
শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায় ,
রোমে রোমে, লোকে লোকান্তরে
গ্রহে সূর্যে তারকায় নিত্যকাল ধ'রে
অনুপরমাণুদের নৃত্যকলরোল –
তোমার আসন ঘেরি অনন্ত কল্লোল ।।
সফলতা
মাঝে মাঝে কতবার ভাবি, কর্মহীন
আজ নষ্ট হল বেলা , নষ্ট হল দিন ।
নষ্ট হয় নাই, প্রভু , সে সকল ক্ষণ –
আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ
ওগো অন্তর্যামী দেব ! অন্তরে অন্তরে
গোপনে প্রচ্ছন্ন রহি কোন অবসরে
বিজেরে অংকুর রূপে তুলেছ জাগায়ে,
মুকুলে প্রস্ফুট-বর্ণে দিয়েছ রাঙায়ে ।
ফুলেরে করেছ ফল রসে সুমধুর ,
বীজে পরিণত গর্ভ । আমি নিদ্রাতুর
আলস্য শয্যার 'পরে শ্রান্তিতে মরিয়া
ভেবেছিনু সর্বকর্ম রহিল পড়িয়া ।।
প্রভাতে জাগিয়া উঠি মেলিনু নয়ন ;
দেখিনু, ভরিয়া আছে কানন ।।
প্রাণ
এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
যে প্রাণ তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়
সেই প্রাণ চুতিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে ,
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে তালে লয়ে
নাচিছে ভুবনে, সেই প্রাণ চুপে চুপে
বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে
লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে ,
বিকাশে পল্লবে পুষ্পে, বরষে বরষে
বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যু-সমূদ্র-দোলায়
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাঁটায় ।
করিতেছি অনুভব, সে অনন্ত প্রাণ
অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান ।।
সে যুগ যুগান্তরের বিরাট স্পন্দন
আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন ।।
দেহলীলা
দেহে আর মনে প্রাণে হয়ে একাকার
একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার ।।
একি জ্যোতি , একি ব্যোম দীপ্ত-দীপ -জ্বালা –
দিবা আর রজনীর শিরোনাট্যশালা ।
একি শ্যাম বসুন্ধরা – সমুদ্রে চঞ্চল,
পর্বতে কঠিন, তরু-পল্লবে কোমল,
অরণ্যে আঁধার ! একি বিচিত্র বিশাল
অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল
আমার ইন্দ্রিয়যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ !
প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে অনন্ত জগৎ ।।
তোমারি মিলনশয্যা, হে মোর রাজন,
ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে অনন্ত আসন
অসীম, বিচিত্র, ক্লান্ত । ওগো বিশ্বভূপ ,
দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ ।।
মুক্তি
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয় ।।
অসংখ বন্ধনমাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ ! এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণগন্ধময় । প্রদীপের মতো
সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দির-মাঝে ।।
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসনে, সে নহে আমার ।
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে ।।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া ,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া ।।
অজ্ঞাতে
তখন করিনি নাথ,কোনো আয়োজন ।
বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন ,
অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে
কত শুভদিনে ; কত মুহূর্তের 'পরে
অসীমের চিহ্নে লিখে গেছ ! লই তুলি
তোমার-স্বাক্ষর-আঁকা সেই ক্ষণগুলি –
দেখি তারা স্মৃতি-মাঝে আছিল ছড়ায়ে
কত-না ধুলির সাথে আছিল জড়ায়ে
ক্ষনিকের কত তুচ্ছ সুখ দুঃখ ঘিরে ।।
হে নাথ , অবজ্ঞা করি যাও নাই ফিরে
আমার এ ধুলাস্তুপ খেলাঘর দেখে
খেলা-মাঝে শুনিতে পেয়েছি থেকে থেকে
যে চরণধ্বনি, আজ শুনি তাই বাজে
জগৎ সংগীত সাথে চন্দ্রসূর্য - মাঝে ।
অপরাহ্নে
প্রভাতে যখন শঙ্খ উঠেছিল বাজি
তোমার প্রাঙ্গণতলে, ভরি লয়ে সাজি
চলেছিল নরনারী তোয়াগিয়া ঘর
নবীন শিশিরসিক্ত গুঞ্জনমুখর
স্নিগ্ধ বনপথ দিয়ে । আমি অন্যমনে
সঘনপল্লবপুঞ্জ ছায়াকুঞ্জবনে
ছিনু শুয়ে তৃণাস্তীর্ণ তরঙ্গীনিতীরে
বিহঙ্গের কলগীতে , সুমন্দ সমীরে ।।
আমি যাই নাই দেব, তোমার পূজায় –
চেয়ে দেখি নাই পথে করা চলে যায় ।
আজি ভাবি, ভালো হয়েছিল মোর ভুল –
তখন কুসুমগুলি আছিল মুকুল ।।
হিরো আজি সারাদিনে ফুটিতেছে আজি ।
অপরাহ্নে ভরিলাম এ পূজার সাজি ।।
প্রতীক্ষা
হে রাজেন্দ্র, তব হাতে কাল অন্তহীন ।
গণনা কেহ না করে ; রাত্রি আর দিন
আসে যায় , ফুটে ঝরে যুগযুগান্তরা ।
বিলম্ব নাহিক তব , নাহি তবে ত্বরা –
প্রতীক্ষা করিতে জানো । শতবর্ষ ধরে
একটি পুষ্পের কলি ফুটাবার তরে
চলে তব ধীর আয়োজন । কাল নাই
আমাদের হাতে ; কাড়াকাড়ি করে তাই
সবে মিলি ; কারো নাহি সহে কভু ।।
আগে তাই সকলের সব সেবা , প্রভু ,
শেষ করে দিতে দিতে কেটে যায় কাল ,
শূন্য পরে থাকে হায় তব পুজাথাল ।।
অসময়ে ছুটে আসি , মনে বাসি ভয় –
এসে দেখে যায় নাই তোমার সময় ।।
অপ্রমত্ত
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে ,
মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে
ভাবোন্মত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা
উদভ্রান্ত উচ্চলফেন ভক্তিমদধারা
নাহি চাহি নাথ ।।
দাও ভক্তি , শান্তিরস ,
স্নিগ্ধ সুধা পূর্ণ করি মঙ্গলকলস
সংসার ভবনদ্বারে । যে ভক্তি-অমৃত
সমস্ত জীবনে মোর বিস্তৃত
নিগূঢ় গভীর – সর্ব কর্মে বল,
ব্যর্থ শুভচেষ্টারেও করিবে সফল
আনন্দ কল্যাণে । সর্ব কর্মে দিবে তৃপ্তি ,
সর্ব দুঃখে দিবে ক্ষেম , সর্ব দীপ্তি
দাহহীন ।।
সম্বরিয়া ভাব-অশ্রুনীর
চিত্ত রবে পরিপূর্ণ, অমত্ত, গম্ভীর ।।
দীক্ষা
আঘাতসংঘাত মাঝে দাঁড়াইনু আসি ।
অঙ্গদ কুন্ডল কন্ঠী অলংকাররাশি
খুলিয়া ফেলেছি দূরে । দাও হস্তে তুলি
নিজ হাতে তোমার অমোঘ শরগুলি,
তোমার অক্ষয় তূণ অস্ত্র দীক্ষা
রণগুরু ! তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিয়া উঠুক আজি কঠিন আদেশে ।।
করো মোরে সম্মানিত নববীরবেশে ,
দুরূহ কর্তব্যভারে, দুঃসহ কঠোর
বেদনায় ! পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর
ক্ষতচিহ্ন অলংকার । ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিষ্ফল প্রয়াসে ।
ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করে দাও সক্ষম স্বাধীন ।।
ত্রাণ
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে , হে মঙ্গলময় ,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয় –
লোকভয় , রাজভয়, মৃত্যুভয় আর ।
দীনপ্রান দুর্বলের এ পাষাণভার ,
এই চিরপেষণযন্ত্রনা , ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি , দন্ডে পলে পলে
এই আত্ম অবমান , অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু , ত্রস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার
মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার –
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো । প্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে ।।
ন্যায়দন্ড
তোমার ন্যায়ের দণ্ড প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছো নিজে, প্রত্যেকের 'পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ !
সে গুরু সন্মান তব, সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে ; তব কার্যে যেন নাহি ডরি
কভু কারে ।।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা ,
হে রুদ্র , নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে । যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খড়খড়্গ সম
তোমার ইঙ্গিতে । জন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান ।।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ।।
প্রার্থনা
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য , উচ্চ্ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি ,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে , যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায় ,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতপথ গ্রাসি –
পৌরুষেরে করেনি শতধা , নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা ,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত ।।
নীড় ও আকাশ
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড় ।
হে সুন্দর , নীড় তব প্রেম সুনিবিড়
প্রতি ক্ষণে নানা বর্ণে, নানা গন্ধে গীতে,
মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারি ভিতে ।
সেথা উষা ডান হাতে ধরি স্বর্ণথালা
নিয়ে আসে এক খানি মাধুর্যের মালা
নীরবে পরায়ে দিতে ধরার ললাটে;
সন্ধ্যা আসে নম্রমুখে ধেনুশূন্য মাঠে
চিহ্নহীন পথ দিয়ে লয়ে স্বর্ণঝারি
পশ্চিমসমুদ্র হতে ভরি শান্তিবারি ।।
তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ
অপার সঞ্চারক্ষেত্র – সেথা শুভ্র ভাস –
দিন নাই রাত্রি নাই , নাই জনপ্রাণী ,
বর্ণ নাই, গন্ধ নাই, নাই নাই বাণী ।।
জন্ম
জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষনে
এ আশ্চর্য সংসারের মহানিকেতনে
সে ক্ষণ অজ্ঞাত মোর । কোন শক্তি মোরে
ফুটাইল এ বিপুল রহস্যের ক্রোড়ে
অর্ধরাত্রে মহারণ্যে মুকুলের মতো ।।
তবু তো প্রভাতে শির করিয়া উন্নত
যখনি নয়ন মেলি নিরাখিনু ধরা
কনককিরণ-গাঁথা নীলাম্বর-পরা,
নিরখিনু সুখে দুঃখে খচিত সংসার –
তখনি অজ্ঞাত এই রহস্য অপার
নিমেষেই মনে হল মাতৃবক্ষ সম ।।
রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি
ধরেছে আমার কাছে জননীমুরতি ।।
মৃত্যু
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর । আজি তার তরে
ক্ষনে ক্ষনে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে ।
সংসারে বিদায় দিতে , আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে ।।
ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এতো আপনার
জনমমুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে ! মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো । জীবন আমার
এতো ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয় ,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয় ।।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে ,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে ।।
নিবেদন
তবে কাছে এই মোর শেষ নিবেদন
সকল ক্ষীণতা মম করহ ছেদন
দৃঢ়বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর ! বীর্য দেহো সুখের সহিতে
সুখেরে কঠিন করি । বীর্য দেহ দুঃখে ,
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিতমুখে
পারে উপেক্ষিত । ভকতিরে বীর্য দেহো
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে উঠি ফুটি । বীর্য দেহো ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীনজ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে । বীর্য দেহো চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার উর্ধে দিতে রাখি ।।
বীর্য দেহো তোমার চরণে রাহি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির ।।
মধ্যাহ্নে নগর মাঝে পথ হতে পথে
কর্মবন্যা ধায় যবে উচ্ছলিত স্রোতে
শত শাখা প্রশাখায় নগরের নাড়ী
উঠে স্ফীত তপ্ত হয়ে, নাচে সে আছাড়ি
পাষাণভিত্তির 'পরে - চৌদিক আকুলি
ধায় পান্থ, ছুটে রথ , উড়ে শুস্ক ধূলি –
তখন সহসা হেরি মুদিয়া নয়ন
মহাজনারণ্য-মাঝে অনন্ত নির্জন
তোমার আসনখানি, কোলাহল মাঝে
তোমার নিঃশব্দ সভা নিস্তব্ধে বিরাজে ।
সব দুঃখে , সব সুখে , সব ঘরে ঘরে ,
সব চিত্তে সব চিন্তা সব চেষ্টা- 'পরে
যত দূর দৃষ্টি যায় শুধু যায় দেখা ,
হে সঙ্গবিহীন দেব , তুমি বসি একা ।।
স্তব্ধতা
আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে ।
জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে
শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার
রয়েছে পড়িয়া শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার
স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি । ক্ষীণ নদীরেখা
নাহি করে গান আজি , নাহি লেখে লেখা
বালুকার তটে । দূরে দূরে পল্লী যত
মুদ্রিত নয়নে রৌদ্র পোহাইতে রত ,
নিদ্রায় অলস, ক্লান্ত ।।
এই স্তব্ধতায়
শুনিতেছি তৃণে তৃণে ধুলায় ধুলায় ,
রোমে রোমে, লোকে লোকান্তরে
গ্রহে সূর্যে তারকায় নিত্যকাল ধ'রে
অনুপরমাণুদের নৃত্যকলরোল –
তোমার আসন ঘেরি অনন্ত কল্লোল ।।
সফলতা
মাঝে মাঝে কতবার ভাবি, কর্মহীন
আজ নষ্ট হল বেলা , নষ্ট হল দিন ।
নষ্ট হয় নাই, প্রভু , সে সকল ক্ষণ –
আপনি তাদের তুমি করেছ গ্রহণ
ওগো অন্তর্যামী দেব ! অন্তরে অন্তরে
গোপনে প্রচ্ছন্ন রহি কোন অবসরে
বিজেরে অংকুর রূপে তুলেছ জাগায়ে,
মুকুলে প্রস্ফুট-বর্ণে দিয়েছ রাঙায়ে ।
ফুলেরে করেছ ফল রসে সুমধুর ,
বীজে পরিণত গর্ভ । আমি নিদ্রাতুর
আলস্য শয্যার 'পরে শ্রান্তিতে মরিয়া
ভেবেছিনু সর্বকর্ম রহিল পড়িয়া ।।
প্রভাতে জাগিয়া উঠি মেলিনু নয়ন ;
দেখিনু, ভরিয়া আছে কানন ।।
প্রাণ
এ আমার শরীরের শিরায় শিরায়
যে প্রাণ তরঙ্গমালা রাত্রিদিন ধায়
সেই প্রাণ চুতিয়াছে বিশ্বদিগ্বিজয়ে ,
সেই প্রাণ অপরূপ ছন্দে তালে লয়ে
নাচিছে ভুবনে, সেই প্রাণ চুপে চুপে
বসুধার মৃত্তিকার প্রতি রোমকূপে
লক্ষ লক্ষ তৃণে তৃণে সঞ্চারে হরষে ,
বিকাশে পল্লবে পুষ্পে, বরষে বরষে
বিশ্বব্যাপী জন্মমৃত্যু-সমূদ্র-দোলায়
দুলিতেছে অন্তহীন জোয়ার-ভাঁটায় ।
করিতেছি অনুভব, সে অনন্ত প্রাণ
অঙ্গে অঙ্গে আমারে করেছে মহীয়ান ।।
সে যুগ যুগান্তরের বিরাট স্পন্দন
আমার নাড়ীতে আজি করিছে নর্তন ।।
দেহলীলা
দেহে আর মনে প্রাণে হয়ে একাকার
একি অপরূপ লীলা এ অঙ্গে আমার ।।
একি জ্যোতি , একি ব্যোম দীপ্ত-দীপ -জ্বালা –
দিবা আর রজনীর শিরোনাট্যশালা ।
একি শ্যাম বসুন্ধরা – সমুদ্রে চঞ্চল,
পর্বতে কঠিন, তরু-পল্লবে কোমল,
অরণ্যে আঁধার ! একি বিচিত্র বিশাল
অবিশ্রাম রচিতেছে সৃজনের জাল
আমার ইন্দ্রিয়যন্ত্রে ইন্দ্রজালবৎ !
প্রত্যেক প্রাণীর মাঝে অনন্ত জগৎ ।।
তোমারি মিলনশয্যা, হে মোর রাজন,
ক্ষুদ্র এ আমার মাঝে অনন্ত আসন
অসীম, বিচিত্র, ক্লান্ত । ওগো বিশ্বভূপ ,
দেহে মনে প্রাণে আমি একি অপরূপ ।।
মুক্তি
বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি, সে আমার নয় ।।
অসংখ বন্ধনমাঝে মহানন্দময়
লভিব মুক্তির স্বাদ ! এই বসুধার
মৃত্তিকার পাত্রখানি ভরি বারম্বার
তোমার অমৃত ঢালি দিবে অবিরত
নানা বর্ণগন্ধময় । প্রদীপের মতো
সংসার মোর লক্ষ বর্তিকায়
জ্বালায়ে তুলিবে আলো তোমারি শিখায়
তোমার মন্দির-মাঝে ।।
ইন্দ্রিয়ের দ্বার
রুদ্ধ করি যোগাসনে, সে নহে আমার ।
যে-কিছু আনন্দ আছে দৃশ্যে গন্ধে গানে
তোমার আনন্দ রবে তার মাঝখানে ।।
মোহ মোর মুক্তিরূপে উঠিবে জ্বলিয়া ,
প্রেম মোর ভক্তিরূপে রহিবে ফলিয়া ।।
অজ্ঞাতে
তখন করিনি নাথ,কোনো আয়োজন ।
বিশ্বের সবার সাথে, হে বিশ্বরাজন ,
অজ্ঞাতে আসিতে হাসি আমার অন্তরে
কত শুভদিনে ; কত মুহূর্তের 'পরে
অসীমের চিহ্নে লিখে গেছ ! লই তুলি
তোমার-স্বাক্ষর-আঁকা সেই ক্ষণগুলি –
দেখি তারা স্মৃতি-মাঝে আছিল ছড়ায়ে
কত-না ধুলির সাথে আছিল জড়ায়ে
ক্ষনিকের কত তুচ্ছ সুখ দুঃখ ঘিরে ।।
হে নাথ , অবজ্ঞা করি যাও নাই ফিরে
আমার এ ধুলাস্তুপ খেলাঘর দেখে
খেলা-মাঝে শুনিতে পেয়েছি থেকে থেকে
যে চরণধ্বনি, আজ শুনি তাই বাজে
জগৎ সংগীত সাথে চন্দ্রসূর্য - মাঝে ।
অপরাহ্নে
প্রভাতে যখন শঙ্খ উঠেছিল বাজি
তোমার প্রাঙ্গণতলে, ভরি লয়ে সাজি
চলেছিল নরনারী তোয়াগিয়া ঘর
নবীন শিশিরসিক্ত গুঞ্জনমুখর
স্নিগ্ধ বনপথ দিয়ে । আমি অন্যমনে
সঘনপল্লবপুঞ্জ ছায়াকুঞ্জবনে
ছিনু শুয়ে তৃণাস্তীর্ণ তরঙ্গীনিতীরে
বিহঙ্গের কলগীতে , সুমন্দ সমীরে ।।
আমি যাই নাই দেব, তোমার পূজায় –
চেয়ে দেখি নাই পথে করা চলে যায় ।
আজি ভাবি, ভালো হয়েছিল মোর ভুল –
তখন কুসুমগুলি আছিল মুকুল ।।
হিরো আজি সারাদিনে ফুটিতেছে আজি ।
অপরাহ্নে ভরিলাম এ পূজার সাজি ।।
প্রতীক্ষা
হে রাজেন্দ্র, তব হাতে কাল অন্তহীন ।
গণনা কেহ না করে ; রাত্রি আর দিন
আসে যায় , ফুটে ঝরে যুগযুগান্তরা ।
বিলম্ব নাহিক তব , নাহি তবে ত্বরা –
প্রতীক্ষা করিতে জানো । শতবর্ষ ধরে
একটি পুষ্পের কলি ফুটাবার তরে
চলে তব ধীর আয়োজন । কাল নাই
আমাদের হাতে ; কাড়াকাড়ি করে তাই
সবে মিলি ; কারো নাহি সহে কভু ।।
আগে তাই সকলের সব সেবা , প্রভু ,
শেষ করে দিতে দিতে কেটে যায় কাল ,
শূন্য পরে থাকে হায় তব পুজাথাল ।।
অসময়ে ছুটে আসি , মনে বাসি ভয় –
এসে দেখে যায় নাই তোমার সময় ।।
অপ্রমত্ত
যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য নাহি মানে ,
মুহূর্তে বিহ্বল হয় নৃত্যগীতগানে
ভাবোন্মত্ততায়, সেই জ্ঞানহারা
উদভ্রান্ত উচ্চলফেন ভক্তিমদধারা
নাহি চাহি নাথ ।।
দাও ভক্তি , শান্তিরস ,
স্নিগ্ধ সুধা পূর্ণ করি মঙ্গলকলস
সংসার ভবনদ্বারে । যে ভক্তি-অমৃত
সমস্ত জীবনে মোর বিস্তৃত
নিগূঢ় গভীর – সর্ব কর্মে বল,
ব্যর্থ শুভচেষ্টারেও করিবে সফল
আনন্দ কল্যাণে । সর্ব কর্মে দিবে তৃপ্তি ,
সর্ব দুঃখে দিবে ক্ষেম , সর্ব দীপ্তি
দাহহীন ।।
সম্বরিয়া ভাব-অশ্রুনীর
চিত্ত রবে পরিপূর্ণ, অমত্ত, গম্ভীর ।।
দীক্ষা
আঘাতসংঘাত মাঝে দাঁড়াইনু আসি ।
অঙ্গদ কুন্ডল কন্ঠী অলংকাররাশি
খুলিয়া ফেলেছি দূরে । দাও হস্তে তুলি
নিজ হাতে তোমার অমোঘ শরগুলি,
তোমার অক্ষয় তূণ অস্ত্র দীক্ষা
রণগুরু ! তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ
ধ্বনিয়া উঠুক আজি কঠিন আদেশে ।।
করো মোরে সম্মানিত নববীরবেশে ,
দুরূহ কর্তব্যভারে, দুঃসহ কঠোর
বেদনায় ! পরাইয়া দাও অঙ্গে মোর
ক্ষতচিহ্ন অলংকার । ধন্য করো দাসে
সফল চেষ্টায় আর নিষ্ফল প্রয়াসে ।
ভাবের ললিত ক্রোড়ে না রাখি নিলীন
কর্মক্ষেত্রে করে দাও সক্ষম স্বাধীন ।।
ত্রাণ
এ দুর্ভাগ্য দেশ হতে , হে মঙ্গলময় ,
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয় –
লোকভয় , রাজভয়, মৃত্যুভয় আর ।
দীনপ্রান দুর্বলের এ পাষাণভার ,
এই চিরপেষণযন্ত্রনা , ধূলিতলে
এই নিত্য অবনতি , দন্ডে পলে পলে
এই আত্ম অবমান , অন্তরে বাহিরে
এই দাসত্বের রজ্জু , ত্রস্ত নতশিরে
সহস্রের পদপ্রান্ততলে বারম্বার
মনুষ্যমর্যাদাগর্ব চিরপরিহার –
এ বৃহৎ লজ্জারাশি চরণ-আঘাতে
চূর্ণ করি দূর করো । প্রভাতে
মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে
উদার আলোক মাঝে, উন্মুক্ত বাতাসে ।।
ন্যায়দন্ড
তোমার ন্যায়ের দণ্ড প্রত্যেকের করে
অর্পণ করেছো নিজে, প্রত্যেকের 'পরে
দিয়েছ শাসনভার হে রাজাধিরাজ !
সে গুরু সন্মান তব, সে দুরূহ কাজ
নমিয়া তোমারে যেন শিরোধার্য করি
সবিনয়ে ; তব কার্যে যেন নাহি ডরি
কভু কারে ।।
ক্ষমা যেথা ক্ষীণ দুর্বলতা ,
হে রুদ্র , নিষ্ঠুর যেন হতে পারি তথা
তোমার আদেশে । যেন রসনায় মম
সত্যবাক্য ঝলি উঠে খড়খড়্গ সম
তোমার ইঙ্গিতে । জন রাখি তব মান
তোমার বিচারাসনে লয়ে নিজ স্থান ।।
অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণসম দহে ।।
প্রার্থনা
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য , উচ্চ্ যেথা শির
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি ,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে , যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায় ,
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতপথ গ্রাসি –
পৌরুষেরে করেনি শতধা , নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা ,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত ।।
নীড় ও আকাশ
একাধারে তুমিই আকাশ, তুমি নীড় ।
হে সুন্দর , নীড় তব প্রেম সুনিবিড়
প্রতি ক্ষণে নানা বর্ণে, নানা গন্ধে গীতে,
মুগ্ধ প্রাণ বেষ্টন করেছে চারি ভিতে ।
সেথা উষা ডান হাতে ধরি স্বর্ণথালা
নিয়ে আসে এক খানি মাধুর্যের মালা
নীরবে পরায়ে দিতে ধরার ললাটে;
সন্ধ্যা আসে নম্রমুখে ধেনুশূন্য মাঠে
চিহ্নহীন পথ দিয়ে লয়ে স্বর্ণঝারি
পশ্চিমসমুদ্র হতে ভরি শান্তিবারি ।।
তুমি যেথা আমাদের আত্মার আকাশ
অপার সঞ্চারক্ষেত্র – সেথা শুভ্র ভাস –
দিন নাই রাত্রি নাই , নাই জনপ্রাণী ,
বর্ণ নাই, গন্ধ নাই, নাই নাই বাণী ।।
জন্ম
জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষনে
এ আশ্চর্য সংসারের মহানিকেতনে
সে ক্ষণ অজ্ঞাত মোর । কোন শক্তি মোরে
ফুটাইল এ বিপুল রহস্যের ক্রোড়ে
অর্ধরাত্রে মহারণ্যে মুকুলের মতো ।।
তবু তো প্রভাতে শির করিয়া উন্নত
যখনি নয়ন মেলি নিরাখিনু ধরা
কনককিরণ-গাঁথা নীলাম্বর-পরা,
নিরখিনু সুখে দুঃখে খচিত সংসার –
তখনি অজ্ঞাত এই রহস্য অপার
নিমেষেই মনে হল মাতৃবক্ষ সম ।।
রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শকতি
ধরেছে আমার কাছে জননীমুরতি ।।
মৃত্যু
মৃত্যুও অজ্ঞাত মোর । আজি তার তরে
ক্ষনে ক্ষনে শিহরিয়া কাঁপিতেছি ডরে ।
সংসারে বিদায় দিতে , আঁখি ছলছলি
জীবন আঁকড়ি ধরি আপনার বলি
দুই ভুজে ।।
ওরে মূঢ়, জীবন সংসার
কে করিয়া রেখেছিল এতো আপনার
জনমমুহূর্ত হতে তোমার অজ্ঞাতে,
তোমার ইচ্ছার পূর্বে ! মৃত্যুর প্রভাতে
সেই অচেনার মুখ হেরিবি আবার
মুহূর্তে চেনার মতো । জীবন আমার
এতো ভালোবাসি বলে হয়েছে প্রত্যয় ,
মৃত্যুরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয় ।।
স্তন হতে তুলে নিলে কাঁদে শিশু ডরে ,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে ।।
নিবেদন
তবে কাছে এই মোর শেষ নিবেদন
সকল ক্ষীণতা মম করহ ছেদন
দৃঢ়বলে, অন্তরের অন্তর হইতে
প্রভু মোর ! বীর্য দেহো সুখের সহিতে
সুখেরে কঠিন করি । বীর্য দেহ দুঃখে ,
যাহে দুঃখ আপনারে শান্তস্মিতমুখে
পারে উপেক্ষিত । ভকতিরে বীর্য দেহো
কর্মে যাহে হয় সে সফল, প্রীতি স্নেহ
পুণ্যে উঠি ফুটি । বীর্য দেহো ক্ষুদ্র জনে
না করিতে হীনজ্ঞান, বলের চরণে
না লুটিতে । বীর্য দেহো চিত্তেরে একাকী
প্রত্যহের তুচ্ছতার উর্ধে দিতে রাখি ।।
বীর্য দেহো তোমার চরণে রাহি শির
অহর্নিশি আপনারে রাখিবারে স্থির ।।
No comments:
Post a Comment