দৃষ্টি
বুঝি গো সন্ধ্যার কাছে শিখেছে সন্ধ্যার মায়া
ওই আঁখিদুটি ,
চাহিলে হৃদয় পানে মরমেতে পরে ছায়া ,
তারা উঠে ফুটি ।
আগে কে জনিত বলো কত কি লুকানো ছিল
হৃদয়নিভৃতে --
তোমার নয়ন দিয়া আমার নিজের হিয়া
পাইনি দেখিতে ।
কখনো গাও নি তুমি , কেবল নীরবে রহি
শিখায়েছ গান -
স্বপ্নময় শান্তিময় পুরোবিরাগিণীতানে
বাঁধিয়েছ প্রাণ ।
আকাশের পানে চাই, সে সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া ।
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আঁধারে পশিয়া ।।
সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়
দেশশূন্য কালশুন্য জ্যোতিঃশুন্য মহাশূন্য - 'পরি
চতুর্মুখ করিছেন ধ্যান ।
সহসা আনন্দসিন্ধু হৃদয়ে উঠিল উথলিয়া ,
আদিদেব খুলিলা নয়ান ।
চারি মুখে বাহিরিল বাণী ,
চারি দিকে করিল প্রয়াণ ।
সীমাহারা মহা-অন্ধকারে
সীমাশূন্য ব্যোমপরিবারে
প্রাণপূর্ণ ঝটিকার মতো ,
আশাপূর্ণ অতৃপ্তির প্রায় ,
সঞ্চারিতে লাগিল সে ভাষা ।।
আনন্দের আন্দোলনে ঘন ঘন বহে শ্বাস ,
অষ্ট নেত্রে বিস্ফুরিল জ্যোতি ।
জ্যোতির্ময় জটাজাল কোটিসূর্যপ্রভা বহি
দিগ্বিদিকে পড়িল ছড়ায়ে ।।
জগতের গঙ্গোত্রিশিখর হ্বতে
শত শত স্রোতে
উচ্ছসিল অগ্নিময় বিশ্বের নির্ঝর,
স্তব্ধতার পাষাণহৃদয়
শত ভাগে গেল বিদীরিয়া ।।
নূতন সে প্রাণের উল্লাসে
নূতন সে প্রাণের উচ্ছ্বাসে
বিশ্ব যবে হয়েছে উন্মাদ ,
অনন্ত আকাশে দাঁড়াইয়া
চারি দিকে চারি হাত দিয়া
বিষ্ণু আসি কৈলা আশীর্বাদ ।
লইয়া মঙ্গলশঙ্খ করে
কাঁপায়ে জগৎ-চরাচরে
বিষ্ণু আসি কৈলা শংখনাদ ।
থেমে এলো প্রচন্ড কল্লোল,
নিতে এল জ্বলন্ত উচ্ছ্বাস,
গ্রহগণ নিজ অশ্রুজলে
নিভাইল নিজের হুতাশ ।
জগতের মহাবেদব্যাস
গঠিলা নিখিল-উপন্যাস ,
বিশৃঙ্খল বিশ্বগীতি লয়ে
মহাকাব্য করিলা রচন ।
চক্রপথে ভ্রমে গ্রহ তারা ,
চক্রপথে রবি শশী ভ্রমে,
শাসনের গদা হস্তে লয়ে
চরাচর রাখিলা নিয়মে ।
মহাছন্দ মহা-অনুপ্রাস
শূন্যে শূন্যে বিস্তারিল পাশ ।।
অতল মানস সরোবরে
বিষ্ণুদেব মেলিল নয়ন ।
আলোককমলদল হতে
উঠিল অতুল রূপরাশি ।
ছড়ালো লক্ষীর হাসিখানি --
মেঘেতে ফুটিল ইন্দ্রধনু,
কাননে ফুটিল ফুলদল ।
জগতের মত্ত কোলাহল
রাগিণীতে হল অবসান ।
কোমলে কঠিন লুকাইল ,
শক্তিরে ঢাকিল রূপরাশি ।।
মহাছন্দে বন্দী হল যুগ-যুগ-যুগ-যুগান্তর--
অসীম জগৎ চরাচর
অবশেষে শ্রান্তকলেবর,
নিদ্রা আসে নয়নে তাহার,
আকর্ষণ হতেছে শিথিল,
উত্তাপ হতেছে একাকার ।
জগতের প্রাণ হতে
উঠিল আকুল আর্তস্বর --
'জাগো জাগো জাগো মহাদেব,
অলঙ্ঘ্য নিয়ম পথে ভ্রমি
হয়েছে বিশ্রান্ত কলেবর,
আমারে নুতন দেহ দাও ।
গাও, দেব, মরণসংগীত --
পাব মোরা নুতন জীবন ।'
জাগিয়া উঠিল মহেশ্বর ,
তিন কাল ত্রিনয়ন মেলি
হেরিলেন দিক-দিগন্তর ।
প্রলয় পিনাক তুলি করে ধরিলেন শূলী
পদতলে জগৎ চাপিয়া,
জগতের আদি অন্ত থরথর থরথর
উঠিল কাঁপিয়া ।
ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল জগতের সমস্ত বাঁধন ।
উঠিল অসীম শূন্যে গরজিয়া তরঙ্গিয়া
ছন্দোমুক্ত জগতের উন্মত্ত আনন্দকোলাহল ।
মহাঅগ্নি উঠিল জ্বলিয়া --
জগতের মহাচিতানল ।
খন্ড খন্ড রবি শশী, চূর্ন চূর্ন গ্রহ তারা
বিন্দু বিন্দু আঁধারের মতো
বরষিছে চারি দিক হতে,
অনলের তেজোময় গ্রাসে
মুহূর্তেই যেতেছে মিশায়ে ।
সৃজনের আরম্ভ-সময়ে
আছিল অনাদি অন্ধকার,
সৃজনের ধ্বংস-যুগান্তরে
রহিল অসীম হুতাশন ।
অনন্ত আকাশ গ্রাসী অনলসমুদ্র মাঝে
মহাদেব মুদি ত্রিনয়ান
করিতে লাগিলা মহাধ্যান ।।
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের 'পর
কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান !
না জানি কেনরে এতো দিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।
জাগিয়া উঠেছে প্রাণ,
ওরে উথলি উঠিছে বারি,
ওরে প্রাণের বাসনা প্রাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি।
থর থর করি কাঁপিছে ভূধর
শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে
ফুলিয়া ফুলিয়া ফেনিল সলিল
গরজি উঠিছে দারুন রোষে
হেথায় হেথায় পাগলের প্রায়
ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায় -
বাহিরিতে চায়, দেখিতে না পায় কোথায় কারার দ্বার।
কেন রে বিধাতা পাষান হেন,
চারিদিকে তার বাঁধন কেন !
ভাঙ রে হৃদয় , ভাঙ রে বাঁধন,
সাধ রে আজিকে প্রাণের সাধন
লহরির পরে লহরী তুলিয়া
আঘাতের 'পরে আঘাত কর।
মাতিয়া যখন উঠেছে পরান
কিসের আঁধার কিসের পাষাণ !
উথলি যখন উঠেছে বাসনা
জগতে তখন কিসের ডর !
আমি ঢালিব করুনাধারা
আমি ভাঙিব পাষাণকারা
আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া,
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিবো রে পড়ান ঢালি।
শিখর হইতে শিখরে ছুটিব
ভূধর হইতে ভূধরে লুটিব ,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।
এত কথা আছে , এত গান আছে , এত প্রাণ আছে মোর,
এতো সুখ আছে , এতো সাধ আছে - প্রাণ হয়ে আছে ভোর ।।
কি জানি কি হলো আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ -
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান।
ওরে, চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর -
ভাঙ ভাঙ ভাঙ কারা , আঘাতে আঘাত কর।
ওরে আজ কি গান গেয়েছে পাখি,
এসেছে রবির কর ।।
প্রভাত-উৎসব
হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি ,
জগৎ আসি সেথা করিছে কোলাকুলি ।
প্রভাত হল যেই কিজানি কি হল একি ,
আকাশ-পানে চাই কি জানি কারে দেখি ।।
পুরব মেঘ মুখে পড়েছে রবিরেখা ,
অরুনরথচূড়া আধেক যায় দেখা ।
তরুণ আলো দেখে পাখির কলরব ,
মধুর আহা কিবা মধুর মধু সব ।।
আকাশ, 'এসো এসো ' ডাকিছ বুঝি ভাই --
গেছি তো তোরি বুকে , আমি তো হেথা নাই ।
প্রভাত-আলো-সাথে ছড়ায় প্রাণ মোর ,
আমার প্রাণ দিয়ে ভরিব প্রাণ তোর ।।
ওঠো হে ওঠো রবি, আমারে তুলে লও ,
অরুণতরী তব পুরবে ছেড়ে দাও ।
আকাশ পারাবার বুঝি হে পার হবে --
আমারে লও তবে, আমারে লও তবে ।।
No comments:
Post a Comment