প্রাণ
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই ।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই !
ধরায় প্রাণের খেলা চির তরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময় —
মানবের সুখ দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি , অমর -আলয় !
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদের মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায় । ।
পুরাতন
হেথা হতে যাও পুরাতন ,
হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি ,
বসন্তের বাতাস বয়েছে।
সুনীল আকাশ 'পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে
শ্রান্ত যেন রবির আলোকে ,
পাখিরা ঝাড়িছে পাখা, কাঁপিছে তরুর শাখা ,
খেলাইছে বালিকা-বালকে । ।
সমুখের সরোবরে আলো ঝিকিমিকি করে ,
ছায়া কাঁপিতেছে থরথর —
জলের পানেতে চেয়ে ঘাটে বসে আছে মেয়ে
শুনিছে পাতার মরমর।
কি জানি কত কি আশে চলিয়াছে চারি পাশে
কত লোক কত সুখে দুঃখে ,
সবাই তো ভুলে আছে, কেহ হাসে কেহ নাচে —
তুমি কেন দাড়াও সমুখে !
বাতাস যেতেছে বহি, তুমি কেন রহি রহি
তারই মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস !
সুদূরে বাজিছে বাঁশি, তুমি কেন ঢাল আসি
তারই মাঝে বিলাপ - উচ্চ্বাস !
উঠিছে প্রভাত রবি , আঁকিছে সোনার ছবি ,
তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া !
বারেক যে চলে যায় তারে তো কেহ না চায় ,
তবু তার কেন এতো মায়া !
তবু কেন সন্ধ্যাকালে জলদের অন্তরালে
লুকায়ে ধরার পানে চায়,
নিশীথের অন্ধকারে পুরানো ঘরের দ্বারে
কেন এসে পুন ফিরে যায় !
কি দেখিতে আসিয়াছে — যাহা-কিছু ফেলে গেছ
কে তাদের করিবে যতন !
স্মরণের চিহ্ন যত ছিল পড়ে দিন-কত
ঝ'রে -পড়া পাতার মতন —
আজি বসন্তের বায় একেকটি করে হায়
উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন ,
ধূলিতে মাটিতে রহি হাসির কিরণে দহি
ক্ষনে ক্ষনে হতেছে মলিন।
ঢাকো তবে ঢাকো মুখ , নিয়ে যাও দুঃখ সুখ ,
চেয়ো না , চেয়ো না ফিরে ফিরে —
হেথায় আলয় নাহি— অনন্তের পানে চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে । ।
নূতন
হেথাও তো পশে সূর্যকর
ঘোর ঝটিকার রাতে দারুন অশনিপাতে
বিদারিল যে গিরিশিখর,
বিশাল পর্বত কেটে পাষাণহৃদয় ফেটে
প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর ,
প্রভাতে পুলকে ভাসি বহিয়া নবীন হাসি
হেথাও তো পশে সূর্যকর !
দুয়ারেতে উঁকি মেরে ফিরে তো যায় না সে রে ,
শিহরি উঠে না আশঙ্কায় —
ভাঙা পাষানের বুকে খেলা করে কোন সুখে ,
হেসে আসে, হেসে চলে যায় ।
হেরো হেরো, হায় হায় , যত প্রতিদিন যায় ।
কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল —
লতাগুলি লতাইয়া বাহুগুলি বিথাইয়া
ঢেকে ফেলে বিদীর্ন কঙ্কাল ।
বজ্রদগ্ধ অতীতের নিরাশার অতিথের
ঘোর স্তব্ধ সমাধি-আবাস
ফুল এসে পাতা এসে কেড়ে নেয় হেসে হেসে ,
অন্ধকারে করে পরিহাস ।
এরা সব কোথা ছিল , কেই বা সংবাদ দিল ,
গৃহহারা আনন্দের দল —
বিশ্বে তিল শূন্য হলে অনাহুত আসে চলে ,
বাসা বেঁধে করে কোলাহল ।
আনে হাসি, আনে গান , আনে রে নতুন প্রাণ ,
সঙ্গে করে আনে রবিকর —
অশোক শিশুর প্রায় এতো হাসে এতো গায়,
কাঁদিতে দেয় না অবসর ।
বিষাদ বিশালকায়া ফেলেছে আঁধার ছায়া ,
তারে এরা করে না তো ভয় —
চারি দিক হতে তারে ছোটো ছোটো হাসি মারে ,
অবশেষে করে পরাজয় ।।
এই-যে মরুস্থল দাবদগ্ধ ধরাতল ,
এখানেই ছিল পুরাতন —
একদিন ছিল তার. শ্যামল যৌবনভার,
ছিল তার দক্ষিণপবন ।
যদি রে সে চলে গেল সঙ্গে যদি নিয়ে গেল
গীত গান হাসি ফুল ফল,
শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে রেখে তবে গেল পিছে —
শুষ্ক শাখা , শুষ্ক ফুলদল !
সে কি চায় শুষ্ক বনে গাহিবে বিহঙ্গগণে
আগে তারা গাহিত যেমন,
আগেকার মতো করে স্নেহে তারা নাম ধরে
উচ্ছসিবে বসন্তপবন !
নহে নহে, সে কি হয় ! সংসার জীবনময় ,
নাহি সেথা মরণের স্থান ।
আয় রে নূতন আয় , সঙ্গে করে নিয়ে আয়
তোর সুখ তোর হাসি গান ।
ফোটা নব ফুলচয় ওঠা নব কিশলয়,
নবীন বসন্ত আয় নিয়ে ।
যে যায় সে চলে যাক— সব তার নিয়ে যাক ,
নাম তার যাক মুছে দিয়ে ।।
বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর
দিনের এল নিবে এলো সূয্যি ডোবে ডোবে
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে
মেঘের উপর মেঘ করেছে , রঙের উপর রঙ
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঠঙ ঠঙ ।
ও পারেতে বৃষ্টি এলো , ঝাপসা গাছপালা ।
এপারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা ।
বাদলা হাওয়ায় মনে পরে ছেলেবেলার গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা , কোথায় বা সীমানা —
দেশে দেশে খেলে বেড়ায় , কেউ করে না মানা ।
কত নতুন ফুলের বনে বিষ্টি দিয়ে যায় ,
পলে পলে নতুন খেলা কোথায় ভেবে পায় !
মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পরে মনে ,
কত দিনের লুকোচুরি কত ঘরের কোণে !
তারি সঙ্গে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
মনে পড়ে ঘরটি আলো, মায়ের হাসিমুখ —
মনে পরে মেঘের ডাকে গুড়ুগুড়ু বুক ।
বিছানাটির একটি পাশে ঘুমিয়ে আছে খোকা ,
মায়ের 'পরে দৌরাত্মি আর সে না যায় লেখাজোকা ।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে করে দাপাদাপি —
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে, সৃষ্টি ওঠে কাঁপি ।
মনে পড়ে মায়ের মুখে শুনেছিলাম গান —
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর , নদেয় এলো বান ।।
মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা ,
মনে পরে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যাথা ।
মনে পরে ঘরের কোনে মিটিমিটি আলো ,
চারিদিকের দেয়াল জুড়ে ছায়া কালো কালো ।
বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু—প্ ঝু—প্ ঝুপ —
দস্যি ছেলে গল্প শোনে , একেবারে চুপ —
তারি সঙ্গে মনে পরে মেঘলা দিনের গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এলো বান ।।
কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা —
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা !
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা !
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা !
তিন কন্যে বিয়ে করে কি হল তার শেষে !
না জানি কোন নদীর ধারে , না জানি কোন দেশে ,
কোন ছেলের ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
গীতোচ্ছাস
নীরব বাঁশিখানি বেজেছে আবার ।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকানন-মাঝে বসন্তসমীরে ।
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত ।
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত ।
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো ।
জগৎ কমল বনে কমল আসনা
কত দিন পরে বুঝি তাই এলো ফিরে ।
সে এলো না — এলো তার মধুর মিলন ,
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর ।
দৃষ্টি তার ফিরে এল , কোথা সে নয়ন !
চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর !
চুম্বন
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা ,
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে —
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধরসঙ্গমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে ।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে —
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা ।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে —
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের লেখা ।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন —
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে !
দুটি এই অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন ।
বাহু
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা —
কাহারে কাঁদিয়া বলে, ' যেয়ো না , যেয়ো না !'
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা ,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা !
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা,
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক-অক্ষরে ।
পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা ,
মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে ।
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে ।
দুটি বাহু বয়ে আনে হৃদয়ের ডালা ,
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে ।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন ,
ছিঁড়ো না, ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন ।।
চরণ
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায়
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায়,
শতলক্ষ কুসুমের পরশস্বপন ।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায়।
প্রভাতের প্রাদোষের দুটি সূর্যালোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় ।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে ,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে —
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় ।
হোথা যে মাটি, শুষ্ক ধরাতল —
এসোগো হৃদয়ে এসো, ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।।
হৃদয় আকাশ
আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি ,
নয়নে দেখেছি তব নুতন আকাশ ।
দুখানি আঁখির পাতে কি রেখেছ ঢাকি,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে ঊষার আভাস।
হৃদয় উড়িতে চায় হেথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস।
ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি ,
হেথায় হারাতে চায় এ গীত - উচ্চ্বাস।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন ,
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরণ —
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।।
স্মৃতি
ওই দেহ - পানে চেয়ে মনে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্ব জনমের স্মৃতি।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে ,
জন্মজন্মান্তরের যেন বসন্তের গীতি।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক ,
কত নব জগতের কুসুমকানন ,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যাথা ,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ -
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন ।।
হৃদয় আসন
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয় ,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয়-সযতন-গোপন হৃদয় !
সেই নিরালায় সেই কোমল আসনে
দুইখানি স্নেহফুট স্তনের ছায়ায়
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায় !
কত-না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় -
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা ,
উদাস নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধ্যায়
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা।
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে
হৃদয়ের সুমধুর স্বপ্নশয়নে ?।
বন্দী
দাও খুলে দাও , সখী ওই বাহুপাশ -
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস -
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।
কোথায় ঊষার আলো , কোথায় আকাশ !
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান !
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ
আকুল আঙুলগুলি করি কোলাকুলি
গাথিছে সর্বাঙ্গে মোর মরণের ফাঁদ।
ঘুমঘোরে শুন্যপানে দেখি মুখ তুলি -
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ ;
স্বাধীন করিয়া দাও, বেঁধো না আমায় -
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তবে পায় ।।
কেন
কেন গো এমন স্বরে বাজে তবে বাঁশি -
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া !
কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায় ,
ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে -
হায় , যদি শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে !
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল ,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া !
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল -
এরই তরে এতো তৃষা , এ কাহার মায়া !
মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা -
খেলা যদি, কেন হেন মর্মভেদী খেলা !
মোহ
এ মোহ ক' দিন থাকে , এ মায়া মিলায়
কিছু পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে -
কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায় ,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায়।
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে।
কোথা সেই হাসিপ্রান্ত চুম্বনতৃষিত
রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর !
কোথা কুসুমিত তনু পূর্ন বিকশিত -
কম্পিত পুলকতরে , যৌবনকাতর !
তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা ,
সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা ,
সেই প্রানপরিপূর্ণ মরণ-অনল -
মনে প'ড়ে হাসি আসে ? চোখে আসে জল ?
মরীচিকা
এসো, ছেড়ে এসো , সখী, কুসুমশয়ান —
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপনচয়ন !
দেখো, ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা —
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আধার নিদ্রা নির্মল অনলে।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে
সুখে দুঃখে যেথা সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয়।
সুখরৌদ্র মরীচিকা নহে বাসস্থান ,
'মিলায় মিলায়' বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ । ।
জীবন্ত হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই !
ধরায় প্রাণের খেলা চির তরঙ্গিত ,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রুময় —
মানবের সুখ দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি , অমর -আলয় !
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদের মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই ,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই ।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায় । ।
পুরাতন
হেথা হতে যাও পুরাতন ,
হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি ,
বসন্তের বাতাস বয়েছে।
সুনীল আকাশ 'পরে শুভ্র মেঘ থরে থরে
শ্রান্ত যেন রবির আলোকে ,
পাখিরা ঝাড়িছে পাখা, কাঁপিছে তরুর শাখা ,
খেলাইছে বালিকা-বালকে । ।
সমুখের সরোবরে আলো ঝিকিমিকি করে ,
ছায়া কাঁপিতেছে থরথর —
জলের পানেতে চেয়ে ঘাটে বসে আছে মেয়ে
শুনিছে পাতার মরমর।
কি জানি কত কি আশে চলিয়াছে চারি পাশে
কত লোক কত সুখে দুঃখে ,
সবাই তো ভুলে আছে, কেহ হাসে কেহ নাচে —
তুমি কেন দাড়াও সমুখে !
বাতাস যেতেছে বহি, তুমি কেন রহি রহি
তারই মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস !
সুদূরে বাজিছে বাঁশি, তুমি কেন ঢাল আসি
তারই মাঝে বিলাপ - উচ্চ্বাস !
উঠিছে প্রভাত রবি , আঁকিছে সোনার ছবি ,
তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া !
বারেক যে চলে যায় তারে তো কেহ না চায় ,
তবু তার কেন এতো মায়া !
তবু কেন সন্ধ্যাকালে জলদের অন্তরালে
লুকায়ে ধরার পানে চায়,
নিশীথের অন্ধকারে পুরানো ঘরের দ্বারে
কেন এসে পুন ফিরে যায় !
কি দেখিতে আসিয়াছে — যাহা-কিছু ফেলে গেছ
কে তাদের করিবে যতন !
স্মরণের চিহ্ন যত ছিল পড়ে দিন-কত
ঝ'রে -পড়া পাতার মতন —
আজি বসন্তের বায় একেকটি করে হায়
উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন ,
ধূলিতে মাটিতে রহি হাসির কিরণে দহি
ক্ষনে ক্ষনে হতেছে মলিন।
ঢাকো তবে ঢাকো মুখ , নিয়ে যাও দুঃখ সুখ ,
চেয়ো না , চেয়ো না ফিরে ফিরে —
হেথায় আলয় নাহি— অনন্তের পানে চাহি
আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে । ।
নূতন
হেথাও তো পশে সূর্যকর
ঘোর ঝটিকার রাতে দারুন অশনিপাতে
বিদারিল যে গিরিশিখর,
বিশাল পর্বত কেটে পাষাণহৃদয় ফেটে
প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর ,
প্রভাতে পুলকে ভাসি বহিয়া নবীন হাসি
হেথাও তো পশে সূর্যকর !
দুয়ারেতে উঁকি মেরে ফিরে তো যায় না সে রে ,
শিহরি উঠে না আশঙ্কায় —
ভাঙা পাষানের বুকে খেলা করে কোন সুখে ,
হেসে আসে, হেসে চলে যায় ।
হেরো হেরো, হায় হায় , যত প্রতিদিন যায় ।
কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল —
লতাগুলি লতাইয়া বাহুগুলি বিথাইয়া
ঢেকে ফেলে বিদীর্ন কঙ্কাল ।
বজ্রদগ্ধ অতীতের নিরাশার অতিথের
ঘোর স্তব্ধ সমাধি-আবাস
ফুল এসে পাতা এসে কেড়ে নেয় হেসে হেসে ,
অন্ধকারে করে পরিহাস ।
এরা সব কোথা ছিল , কেই বা সংবাদ দিল ,
গৃহহারা আনন্দের দল —
বিশ্বে তিল শূন্য হলে অনাহুত আসে চলে ,
বাসা বেঁধে করে কোলাহল ।
আনে হাসি, আনে গান , আনে রে নতুন প্রাণ ,
সঙ্গে করে আনে রবিকর —
অশোক শিশুর প্রায় এতো হাসে এতো গায়,
কাঁদিতে দেয় না অবসর ।
বিষাদ বিশালকায়া ফেলেছে আঁধার ছায়া ,
তারে এরা করে না তো ভয় —
চারি দিক হতে তারে ছোটো ছোটো হাসি মারে ,
অবশেষে করে পরাজয় ।।
এই-যে মরুস্থল দাবদগ্ধ ধরাতল ,
এখানেই ছিল পুরাতন —
একদিন ছিল তার. শ্যামল যৌবনভার,
ছিল তার দক্ষিণপবন ।
যদি রে সে চলে গেল সঙ্গে যদি নিয়ে গেল
গীত গান হাসি ফুল ফল,
শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে রেখে তবে গেল পিছে —
শুষ্ক শাখা , শুষ্ক ফুলদল !
সে কি চায় শুষ্ক বনে গাহিবে বিহঙ্গগণে
আগে তারা গাহিত যেমন,
আগেকার মতো করে স্নেহে তারা নাম ধরে
উচ্ছসিবে বসন্তপবন !
নহে নহে, সে কি হয় ! সংসার জীবনময় ,
নাহি সেথা মরণের স্থান ।
আয় রে নূতন আয় , সঙ্গে করে নিয়ে আয়
তোর সুখ তোর হাসি গান ।
ফোটা নব ফুলচয় ওঠা নব কিশলয়,
নবীন বসন্ত আয় নিয়ে ।
যে যায় সে চলে যাক— সব তার নিয়ে যাক ,
নাম তার যাক মুছে দিয়ে ।।
বৃষ্টি পরে টাপুর টুপুর
দিনের এল নিবে এলো সূয্যি ডোবে ডোবে
আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে
মেঘের উপর মেঘ করেছে , রঙের উপর রঙ
মন্দিরেতে কাঁসর ঘন্টা বাজলো ঠঙ ঠঙ ।
ও পারেতে বৃষ্টি এলো , ঝাপসা গাছপালা ।
এপারেতে মেঘের মাথায় একশো মানিক জ্বালা ।
বাদলা হাওয়ায় মনে পরে ছেলেবেলার গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
আকাশ জুড়ে মেঘের খেলা , কোথায় বা সীমানা —
দেশে দেশে খেলে বেড়ায় , কেউ করে না মানা ।
কত নতুন ফুলের বনে বিষ্টি দিয়ে যায় ,
পলে পলে নতুন খেলা কোথায় ভেবে পায় !
মেঘের খেলা দেখে কত খেলা পরে মনে ,
কত দিনের লুকোচুরি কত ঘরের কোণে !
তারি সঙ্গে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
মনে পড়ে ঘরটি আলো, মায়ের হাসিমুখ —
মনে পরে মেঘের ডাকে গুড়ুগুড়ু বুক ।
বিছানাটির একটি পাশে ঘুমিয়ে আছে খোকা ,
মায়ের 'পরে দৌরাত্মি আর সে না যায় লেখাজোকা ।
ঘরেতে দুরন্ত ছেলে করে দাপাদাপি —
বাইরেতে মেঘ ডেকে ওঠে, সৃষ্টি ওঠে কাঁপি ।
মনে পড়ে মায়ের মুখে শুনেছিলাম গান —
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর , নদেয় এলো বান ।।
মনে পড়ে সুয়োরানী দুয়োরানীর কথা ,
মনে পরে অভিমানী কঙ্কাবতীর ব্যাথা ।
মনে পরে ঘরের কোনে মিটিমিটি আলো ,
চারিদিকের দেয়াল জুড়ে ছায়া কালো কালো ।
বাইরে কেবল জলের শব্দ ঝু—প্ ঝু—প্ ঝুপ —
দস্যি ছেলে গল্প শোনে , একেবারে চুপ —
তারি সঙ্গে মনে পরে মেঘলা দিনের গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এলো বান ।।
কবে বিষ্টি পড়েছিল, বান এল সে কোথা —
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল কবেকার সে কথা !
সেদিনও কি এমনিতরো মেঘের ঘটাখানা !
থেকে থেকে বাজ-বিজুলি দিচ্ছিল কি হানা !
তিন কন্যে বিয়ে করে কি হল তার শেষে !
না জানি কোন নদীর ধারে , না জানি কোন দেশে ,
কোন ছেলের ঘুম পাড়াতে কে গাহিল গান —
বিষ্টি পরে টাপুর টুপুর , নদেয় এল বান ।।
গীতোচ্ছাস
নীরব বাঁশিখানি বেজেছে আবার ।
প্রিয়ার বারতা বুঝি এসেছে আমার
বসন্তকানন-মাঝে বসন্তসমীরে ।
তাই বুঝি মনে পড়ে ভোলা গান যত ।
তাই বুঝি ফুলবনে জাহ্নবীর তীরে
পুরাতন হাসিগুলি ফুটে শত শত ।
তাই বুঝি হৃদয়ের বিস্মৃত বাসনা
জাগিছে নবীন হয়ে পল্লবের মতো ।
জগৎ কমল বনে কমল আসনা
কত দিন পরে বুঝি তাই এলো ফিরে ।
সে এলো না — এলো তার মধুর মিলন ,
বসন্তের গান হয়ে এল তার স্বর ।
দৃষ্টি তার ফিরে এল , কোথা সে নয়ন !
চুম্বন এসেছে তার, কোথা সে অধর !
চুম্বন
অধরের কানে যেন অধরের ভাষা ,
দোঁহার হৃদয় যেন দোঁহে পান করে —
গৃহ ছেড়ে নিরুদ্দেশ দুটি ভালোবাসা
তীর্থযাত্রা করিয়াছে অধরসঙ্গমে।
দুইটি তরঙ্গ উঠি প্রেমের নিয়মে
ভাঙিয়া মিলিয়া যায় দুইটি অধরে ।
ব্যাকুল বাসনা দুটি চাহে পরস্পরে —
দেহের সীমায় আসি দুজনের দেখা ।
প্রেম লিখিতেছে গান কোমল আখরে —
অধরেতে থরে থরে চুম্বনের লেখা ।
দুখানি অধর হতে কুসুমচয়ন —
মালিকা গাঁথিবে বুঝি ফিরে গিয়ে ঘরে !
দুটি এই অধরের এই মধুর মিলন
দুইটি হাসির রাঙা বাসরশয়ন ।
বাহু
কাহারে জড়াতে চাহে দুটি বাহুলতা —
কাহারে কাঁদিয়া বলে, ' যেয়ো না , যেয়ো না !'
কেমনে প্রকাশ করে ব্যাকুল বাসনা ,
কে শুনেছে বাহুর নীরব আকুলতা !
কোথা হতে নিয়ে আসে হৃদয়ের কথা,
গায়ে লিখে দিয়ে যায় পুলক-অক্ষরে ।
পরশে বহিয়া আনে মরমবারতা ,
মোহ মেখে রেখে যায় প্রাণের ভিতরে ।
কণ্ঠ হতে উতারিয়া যৌবনের মালা
দুইটি আঙুলে ধরি তুলি দেয় গলে ।
দুটি বাহু বয়ে আনে হৃদয়ের ডালা ,
রেখে দিয়ে যায় যেন চরণের তলে ।
লতায়ে থাকুক বুকে চির আলিঙ্গন ,
ছিঁড়ো না, ছিঁড়ো না দুটি বাহুর বন্ধন ।।
চরণ
দুখানি চরণ পড়ে ধরণীর গায়
দুখানি অলস রাঙা কোমল চরণ ।
শত বসন্তের স্মৃতি জাগিছে ধরায়,
শতলক্ষ কুসুমের পরশস্বপন ।
শত বসন্তের যেন ফুটন্ত অশোক
ঝরিয়া মিলিয়া গেছে দুটি রাঙা পায়।
প্রভাতের প্রাদোষের দুটি সূর্যালোক
অস্ত গেছে যেন দুটি চরণছায়ায় ।
যৌবনসংগীত পথে যেতেছে ছড়ায়ে ,
নূপুর কাঁদিয়া মরে চরণ জড়ায়ে —
নৃত্য সদা বাঁধা যেন মধুর মায়ায় ।
হোথা যে মাটি, শুষ্ক ধরাতল —
এসোগো হৃদয়ে এসো, ঝুরিছে হেথায়
লাজরক্ত লালসার রাঙা শতদল ।।
হৃদয় আকাশ
আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি ,
নয়নে দেখেছি তব নুতন আকাশ ।
দুখানি আঁখির পাতে কি রেখেছ ঢাকি,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে ঊষার আভাস।
হৃদয় উড়িতে চায় হেথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস।
ওই গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি ,
হেথায় হারাতে চায় এ গীত - উচ্চ্বাস।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন ,
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরণ —
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ ।।
স্মৃতি
ওই দেহ - পানে চেয়ে মনে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্ব জনমের স্মৃতি।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে ,
জন্মজন্মান্তরের যেন বসন্তের গীতি।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক ,
কত নব জগতের কুসুমকানন ,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যাথা ,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ -
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন ।।
হৃদয় আসন
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয় ,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয়-সযতন-গোপন হৃদয় !
সেই নিরালায় সেই কোমল আসনে
দুইখানি স্নেহফুট স্তনের ছায়ায়
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায় !
কত-না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় -
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা ,
উদাস নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধ্যায়
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা।
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে
হৃদয়ের সুমধুর স্বপ্নশয়নে ?।
বন্দী
দাও খুলে দাও , সখী ওই বাহুপাশ -
চুম্বনমদিরা আর করায়ো না পান।
কুসুমের কারাগারে রুদ্ধ এ বাতাস -
ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও বদ্ধ এ পরান।
কোথায় ঊষার আলো , কোথায় আকাশ !
এ চির পূর্ণিমারাত্রি হোক অবসান !
আমারে ঢেকেছে তব মুক্ত কেশপাশ ,
তোমার মাঝারে আমি নাহি দেখি ত্রাণ
আকুল আঙুলগুলি করি কোলাকুলি
গাথিছে সর্বাঙ্গে মোর মরণের ফাঁদ।
ঘুমঘোরে শুন্যপানে দেখি মুখ তুলি -
শুধু অবিশ্রামহাসি একখানি চাঁদ ;
স্বাধীন করিয়া দাও, বেঁধো না আমায় -
স্বাধীন হৃদয়খানি দিব তবে পায় ।।
কেন
কেন গো এমন স্বরে বাজে তবে বাঁশি -
মধুর সুন্দর রূপে কেঁদে ওঠে হিয়া,
রাঙা অধরের কোণে হেরি মধুহাসি
পুলকে যৌবন কেন উঠে বিকশিয়া !
কেন তনু বাহুডোরে ধরা দিতে চায় ,
ধায় প্রাণ দুটি কালো আঁখির উদ্দেশে -
হায় , যদি শ্রান্তি নিমেষে নিমেষে !
কেন কাছে ডাকে যদি মাঝে অন্তরাল ,
কেন রে কাঁদায় প্রাণ সবই যদি ছায়া !
আজ হাতে তুলে নিয়ে ফেলে দিবে কাল -
এরই তরে এতো তৃষা , এ কাহার মায়া !
মানবহৃদয় নিয়ে এত অবহেলা -
খেলা যদি, কেন হেন মর্মভেদী খেলা !
মোহ
এ মোহ ক' দিন থাকে , এ মায়া মিলায়
কিছু পারে না আর বাঁধিয়া রাখিতে -
কোমল বাহুর ডোর ছিন্ন হয়ে যায় ,
মদিরা উথলে নাকো মদির আঁখিতে।
কেহ কারে নাহি চিনে আঁধার নিশায়।
ফুল ফোটা সাঙ্গ হলে গাহে না পাখিতে।
কোথা সেই হাসিপ্রান্ত চুম্বনতৃষিত
রাঙা পুষ্পটুকু যেন প্রস্ফুট অধর !
কোথা কুসুমিত তনু পূর্ন বিকশিত -
কম্পিত পুলকতরে , যৌবনকাতর !
তখন কি মনে পড়ে সেই ব্যাকুলতা ,
সেই চিরপিপাসিত যৌবনের কথা ,
সেই প্রানপরিপূর্ণ মরণ-অনল -
মনে প'ড়ে হাসি আসে ? চোখে আসে জল ?
মরীচিকা
এসো, ছেড়ে এসো , সখী, কুসুমশয়ান —
বাজুক কঠিন মাটি চরণের তলে।
কত আর করিবে গো বসিয়া বিরলে
আকাশকুসুমবনে স্বপনচয়ন !
দেখো, ওই দূর হতে আসিছে ঝটিকা —
স্বপ্নরাজ্য ভেসে যাবে খর অশ্রুজলে।
দেবতার বিদ্যুতের অভিশাপশিখা
দহিবে আধার নিদ্রা নির্মল অনলে।
চলো গিয়ে থাকি দোঁহে মানবের সাথে
সুখে দুঃখে যেথা সবে গাঁথিছে আলয় —
হাসি কান্না ভাগ করি ধরি হাতে হাতে
সংসারসংশয়রাত্রি রহিব নির্ভয়।
সুখরৌদ্র মরীচিকা নহে বাসস্থান ,
'মিলায় মিলায়' বলি ভয়ে কাঁপে প্রাণ । ।
No comments:
Post a Comment