তুমি মোরে করেছ সম্রাট। তুমি মোরে
সাজায়েছো কন্ঠ মোর । তব রাজটিকা
সাজায়েছো কন্ঠ মোর । তব রাজটিকা
পরায়েছো গৌরবমুকুট ; পুষ্পডোরে
দীপিছে ললাট মাঝে মহিমার শিখা
অহর্নিশি। আমার সকল দৈন্য লাজ ,
আমার ক্ষুদ্রতা যত , ঢাকিয়াছে আজ
তব রাজ আস্তরণে। হৃদিশয্যাতল
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ, কোমল শীতল ,
তারই মাঝে বসয়েছো। সমস্ত জগৎ
বাহিরে দাঁড়ায়ে আছে, নাহি পায় পথ
আমারে চৌদিকে ঘিরি সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি ; অমরবীণায়
উঠিয়াছে কি ঝংকার ! নিত্য শুনা যায়
দূর দূরান্তর হতে দেশ বিদেশের
ভাষা, যুগ যুগান্তের কথা, দিবসের
নিশীথের গান, মিলনের বিরহের
গাথা, তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের
উৎকন্ঠিত তান ।।
প্রেমের অমরাবতী,
প্রদোষ-আলোকে যেথা দয়মন্তীসতী
বিচরে নলের সনে দীর্ঘনিশ্বসিত
অরণ্যের বিষাদমর্মরে ; বিকশিত
পুস্পবীথিতলে শকুন্তলা আছে বসি ,
করপদ্মতললীন ম্লান মুখশশী ,
ধ্যানরতা ; পুরুরবা ফিরে অহরহ
বনে বনে পীতস্বরে দুঃসহ বিরহ
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে ; মহারণ্যে যেথা ,
বীণা হস্তে লয়ে , তপস্বিনী মহাশ্বেতা
মহেশমন্দিরতলে বসি একাকিনী
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিনী
সান্তনা সিঞ্চিত ; গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল
চুম্বিছে ফাল্গুনী ; ভিখারি শিবের কোল
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্বতীরে
অনন্তব্যগ্রতাপাশে ; সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রুমন্দাকিনী , মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানচ্ছবি করে
করুণায় ; বাঁশরির ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করেছে সন্ধান
হৃদয়সাথীরে - হাত ধ'রে মোরে তুমি
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দনভূমি
অমৃত - আলয়ে। সেথা আমি জ্যোতিস্মান
অক্ষয়যৌবনময় দেবতাসমান,
সেথা মোর লাবণ্যের নাহি পরিসীমা,
সেথা মোরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা
নিখিল প্রণয়ী ; সেথা মোর সভাসদ
রবিচন্দ্রতারা , পরি নব পরিচ্ছদ
শুনায় আমারে তারা নব নব গান
নব অর্থ ভরা ; চিরসুহৃদসমান
সর্ব চরাচর ।।
হেথা আমি কেহ নহি ,
সহস্রের মাঝে একজন - সদা বহি
সংসারের ক্ষুদ্র ভার , কত অনুগ্রহ
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ ।
সেই শত সহস্রের পরিচয়হীন
প্রবাহ হইতে এই তুচ্ছকর্মাধীন
মোরে তুমি লয়েছ তুলিয়া, নাহি জানি
কী কারণে , অয়ি মহিয়সী মহারানী ,
তুমি মোরে করিয়াছ মহীয়ান। আজি
এই-যে আমারে ঠেলি চলে জনরাজি
না তাকায়ে মোর মুখে, তাহারা কি জানে
নিশিদিন তোমার সোহাগসুধা-পানে
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর ? তাহারা কি
পায় দেখিবারে - নিত্য মোরে আছে ঢাকি
মন তব অভিনব লাবণ্যবসনে ?
তব স্পর্শ, তব প্রেম , রেখেছি যতনে -
তব সুধাকণ্ঠবাণী, তোমার চুম্বন ,
তোমার আঁখির দৃষ্টি সর্বদেহমন
পূর্ণ করি - রেখেছে যেমন সুধাকর
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগ যুগান্তর
আপনারে সুধাপাত্র করি ; বিধাতার
পূণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার
সবিতা যেমন সযতনে ; কমলার
চরণকিরণে যথা পরিয়াছে হার
সুনির্মল গগনের অনন্ত ললাট।
হে মহিমাময়ী, মোরে করেছ সম্রাট ।।
জোড়াসাঁকো। কলিকাতা
১৪ মাঘ ১৩০০
No comments:
Post a Comment