Premer Obhishek - প্রেমের অভিষেক - by Rabindranath Tagore - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


তুমি মোরে করেছ সম্রাট।  তুমি মোরে 
সাজায়েছো কন্ঠ মোর । তব রাজটিকা 
পরায়েছো গৌরবমুকুট ; পুষ্পডোরে 
দীপিছে ললাট মাঝে মহিমার শিখা 
অহর্নিশি।  আমার সকল দৈন্য লাজ ,
আমার ক্ষুদ্রতা যত , ঢাকিয়াছে আজ 
তব রাজ আস্তরণে।  হৃদিশয্যাতল 
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ, কোমল শীতল ,
তারই মাঝে বসয়েছো।  সমস্ত জগৎ 
বাহিরে দাঁড়ায়ে আছে, নাহি পায় পথ 
সে অন্তর - অন্তঃপুরে।  নিভৃত সভায় 
আমারে চৌদিকে ঘিরি সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি ; অমরবীণায় 
উঠিয়াছে কি ঝংকার ! নিত্য শুনা যায় 
দূর দূরান্তর হতে দেশ বিদেশের 
ভাষা, যুগ যুগান্তের কথা, দিবসের 
নিশীথের গান, মিলনের বিরহের 
গাথা, তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের 
উৎকন্ঠিত তান ।।

                       প্রেমের অমরাবতী, 
প্রদোষ-আলোকে যেথা দয়মন্তীসতী
বিচরে নলের সনে দীর্ঘনিশ্বসিত 
অরণ্যের বিষাদমর্মরে ; বিকশিত 
পুস্পবীথিতলে শকুন্তলা আছে বসি ,
করপদ্মতললীন ম্লান মুখশশী ,
ধ্যানরতা ; পুরুরবা ফিরে অহরহ 
বনে বনে পীতস্বরে দুঃসহ বিরহ 
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে ; মহারণ্যে যেথা ,
বীণা হস্তে লয়ে , তপস্বিনী মহাশ্বেতা 
মহেশমন্দিরতলে বসি একাকিনী 
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিনী 
সান্তনা সিঞ্চিত ; গিরিতটে শিলাতলে 
কানে কানে প্রেমবার্তা কহিবার ছলে 
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল 
চুম্বিছে ফাল্গুনী ; ভিখারি শিবের কোল 
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্বতীরে 
অনন্তব্যগ্রতাপাশে ; সুখদুঃখনীরে 
বহে অশ্রুমন্দাকিনী , মিনতির স্বরে 
কুসুমিত বনানীরে ম্লানচ্ছবি করে 
করুণায় ; বাঁশরির ব্যথাপূর্ণ তান 
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করেছে সন্ধান 
হৃদয়সাথীরে - হাত ধ'রে মোরে তুমি 
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দনভূমি 
অমৃত - আলয়ে।  সেথা আমি জ্যোতিস্মান 
অক্ষয়যৌবনময় দেবতাসমান, 
সেথা মোর লাবণ্যের নাহি পরিসীমা,
সেথা মোরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা 
নিখিল প্রণয়ী ; সেথা মোর সভাসদ 
রবিচন্দ্রতারা , পরি নব পরিচ্ছদ 
শুনায়  আমারে তারা নব নব গান 
নব অর্থ ভরা ; চিরসুহৃদসমান 
সর্ব চরাচর  ।।

                হেথা আমি কেহ নহি ,
সহস্রের মাঝে একজন - সদা বহি 
সংসারের ক্ষুদ্র ভার , কত অনুগ্রহ 
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ ।
সেই শত সহস্রের পরিচয়হীন 
প্রবাহ হইতে এই তুচ্ছকর্মাধীন 
মোরে তুমি লয়েছ তুলিয়া, নাহি জানি 
কী কারণে , অয়ি মহিয়সী মহারানী ,
তুমি মোরে করিয়াছ মহীয়ান।  আজি 
এই-যে আমারে ঠেলি চলে জনরাজি 
না তাকায়ে মোর মুখে, তাহারা কি জানে 
নিশিদিন তোমার সোহাগসুধা-পানে  
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর ? তাহারা কি 
পায় দেখিবারে - নিত্য মোরে আছে ঢাকি 
মন তব অভিনব লাবণ্যবসনে ?
তব স্পর্শ, তব প্রেম , রেখেছি যতনে -
তব সুধাকণ্ঠবাণী, তোমার চুম্বন ,
তোমার আঁখির দৃষ্টি সর্বদেহমন 
পূর্ণ করি - রেখেছে যেমন সুধাকর 
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগ যুগান্তর 
আপনারে সুধাপাত্র করি ; বিধাতার 
পূণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার 
সবিতা যেমন সযতনে ; কমলার 
চরণকিরণে যথা পরিয়াছে হার 
সুনির্মল গগনের অনন্ত ললাট। 
হে মহিমাময়ী, মোরে করেছ সম্রাট ।।

জোড়াসাঁকো।  কলিকাতা 
১৪ মাঘ ১৩০০



No comments:

Post a Comment