Puraton bhrityo - পুরাতন ভৃত্য - Poem by Rabindranath Tagore


ভুতের মতন চেহারা যেমন নির্বোধ অতি ঘোর -
যা-কিছু হারায় গিন্নি বলেন কেষ্টা বেটাই চোর ।
উঠিতে বসিতে করি বাপান্তও, শুনেও শোনে না কানে -
যত পায় বেত পায় না বেতন, তবু না চেতন মানে ।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ , চিৎকার করি 'কেষ্টা' -
যত করি তাড়া নাহি পায় সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা ।
তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে -
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা ক'রে আনে ।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা -
মহাকলরবে গালি দেই যবে 'পাজি হতভাগা গাধা'
দরজার পাশে দাড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্বলে যায় পিত্ত ।
তবু মায়া তার ত্যাগ করা ভার - বড়ো পুরাতন ভৃত্য ।।

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষমূর্তি বলে , ' আর পারি নাকো -
রহিল তোমার এ ঘরদুয়ার, কেষ্টারে লয়ে থাকো ।
না মানে শাসন, বসন বাসন অশন আসন যত ।
কোথায় কি গেল - শুধু তাকাগুলো যেতেছে জলের মতো ।
গেলে সে বাজার সাড়া দিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার ।
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মিলে না আর !'
শুনে মহা রেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধ'রে -
বলি তারে, ' পাজি বেরো তুই আজই, দূর করে দিনু তোরে ।'
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায় । পরদিন উঠে দেখি
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি ।
প্রসন্ন মুখ নাহি কোন দুখ , অতি অকাতরচিত্ত -
ছাড়ালে না ছাড়ে , কি করিব তারে, মোর পুরাতন ভৃত্য ।।
 
সে বছর ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালালগিরি ।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি ।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, বুঝায়ে বলিনু তারে -
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য , নহিলে খরচ বাড়ে ।
লয়ে রশারশি করি কষাকষি পোটলা পুঁটলি বাঁধি 
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি ,
'পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে ।'
আমি কহিলাম , 'আরে রাম রাম, নিবারণ সাথে যাবে ।'
রেলগাড়ি ধায় ; হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত তামাক সাজিয়া আনে ।
স্পর্ধা তাহার হেনমতে আর কত-বা সহিব নিত্য ?
যত তারে দুষি তবু হনু খুশি হেরি পুরাতন ভৃত্য ।।

নামিনু শ্রীধামে ; দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত ।
জন-ছয়-সাতে মিলি একসাথে পরম বন্ধুভাবে 
করিলাম বাসা ; মনে হল আশা আরামে দিবস যাবে । -
কোথা ব্রজবালা, কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি !
কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত ! আমি বসন্তে মরি ।
বন্ধু যে-যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ -
আমি একা ঘরে, ব্যাধি খরশরে ভরিল সকল অঙ্গ ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ, ক্ষীণ , 'কেষ্ট , আয় রে কাছে,
এত দিন শেষে আসিয়া বিদেশে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে ।'
হেরি তার মুখ ভরে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত -
নিশিদিন ধ'রে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরাতন ভৃত্য ।।

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে মোর দেয় হাত ,
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত ।
বলে বারে বার, 'কর্তা, তোমার কোন ভয় নাই, শুন -
যাবে দেশে ফিরে, মাঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন ।' 
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম, তাহারে ধরিল জ্বরে ;
নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ'পরে ।
হয়ে জ্ঞ্যানহীন কাটিল দু দিন , বন্ধ হইল নাড়ী -
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে , এত দিনে গেল ছাড়ি ।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরিনু ছাড়িয়া তীর্থ ।
আজ সাথে নেই চিরসাথি সেই মোর পুরাতন ভৃত্য ।।

[শিলাইদহ , ১২ ফাল্গুন , ১৩০১]


No comments:

Post a Comment