Geetali - Rabindranath Tagore

                        পরশমণি 

আগুনের       পরশমণি            ছোঁয়াও প্রাণে,
এ জীবন        পুন্য করো           দহন দানে ।
আমার এই     দেহ খানি            তুলে ধরো ,
তোমার ওই   দেবালয়ের           প্রদীপ করো  -
নিশিদিন       আলোক-শিখা       জ্বলুক গানে ।
আগুনের     পরশ-মণি              ছোঁয়াও প্রাণে ।।

আঁধারের       গায়ে গায়ে         পরশ তব
সারারাত       ফোটাক তারা    নব নব ।
নয়নের         দৃষ্টি হতে            ঘুচবে কালো ,
যেখানে         পরবে সেথায়      দেখবে আলো -
ব্যাথা মোর    উঠবে জ্বলে        উর্ধ-পানে ।
আগুনের         পরশ-মণি        ছোঁয়াও প্রাণে ।।

[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]



                      শরন্ময়ী 

                এই শরৎ আলোর কমল বোনে
বাহির হয়ে বিহার করে.  যে ছিল মোর মনে মনে ।
তারই সোনার কাকন বাজে আজি প্রভাত কিরণ মাঝে ,
যাওয়ার কাপে আঁচলখানি — ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে ।

                আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু   পড়ে থাকে তরুর তলে ।
হৃদয়-মাঝে হৃদয় দুলায় , বাহিরে সে ভুবন ভুলায় —
আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে ।।

[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]


                        মোহন মৃত্যু

             তোমার মহান রূপে কে রয় ভুলে !
জানি না কি মরন নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে !
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে   কিসের ঝলক নেচে উঠে,
            ঝড় এনেছ এলো চুলে ।
                       মোহন রূপে কে রয় ভুলে ?।
                       কাঁপন ধরে বাতাসেতে -
পাকা ধানের তরাস লাগে,               শিউরে উঠে ভরা ক্ষেতে ।
জানি গো আজ হাহারবে                 তোমার পুজা সারা হবে
                 নিখিল - অশ্রু - সাগর - কূলে ।
                              মোহন রূপে কে রয় ভুলে ? ।

[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]



                         শারদা 

        শরৎ, তোমার অরুণ আলোর  অঞ্জলি
        ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন আঙ্গুলি ।
শরৎ, তোমার শিশির - ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
                    আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি ।।

        মানিক - গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
        ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে ।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সংগীতে
ওড়না ওড়ায় একি  নাচের ভঙ্গিতে -
                   শিউলিবনের বুক যে ওঠে  আন্দোলি ।।

[ সুরুল, ১৯ ভাদ্র ১৩২১]


                     জয়

মোর          মরণে তোমার হবে জয় ।
মোর          জীবনে তোমার পরিচয় ।
মোর          দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজ          ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর          আনন্দ সে যে মণিহার
                 মুকুটে তোমার বাঁধা রয় ।।
মোর         ত্যাগে যে তোমার হবে জয় ।
মোর         প্রেমে যে তোমার পরিচয় ।
মোর         ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে        লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর         বীর্য তোমার জয়রথ
                তোমারি পতাকা শিরে রয় ।।

[ সুরুল, ২২ ভাদ্র ১৩২১]


                    ক্লান্তি

       ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো, প্রভু,
       পথে যদি পিছিয়ে পরি কভু ।
এই-যে হিয়া থরো থরো              কাঁপে আজি এমনতরো
        এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।

        এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
        পিছন - পানে তাকাই যদি কভু ।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায়            শুকায় মালা পুজার থালায়,
        সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।

[শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১]




                             পথিক

          আমি পথিক, পথ আমার সাথি ।
দিন সে কাটায় গণি গণি             বিশ্বলোকের চরণধ্বনি,
          তারার আলোয় গায় সে সারা রাতি ।
কত যুগের রথের রেখা              বক্ষে তাহার আকে লেখা,
                  কত কালের ক্লান্ত আশা
           ঘুমায় তাহার ধুলায় আঁচল পাতি ।।
             বাহির হলেম কবে সে নাই মনে ।
যাত্রা আমার চলার পাকে             এই পথেরই বাঁকে বাঁকে
               নুতন হল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ।
যত আশা পথের আশা,               পথে যেতেই ভালবাসা -
                    পথে-চলার নিত্য রসে
               দিনে দিনে জীবন ওঠে মাতি ।।

[শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১]



                              পুনরাবর্তন

        আবার যদি ইচ্ছে কর আবার আসি ফিরে
        দুঃখ সুখের ঢেউ খেলানো এই সাগরের তীরে ।
আবার জলে ভাসায় ভেলা,                   ধূলার 'পরে করি খেলা,
        হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়নতীরে ।।

        কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
        আঘাত খেয়ে বাঁচি কিম্বা আঘাত খেয়ে মরি ।
আমার তুমি ছদ্মবেশে                          আমার সাথে খেলাও হেসে -
           নুতন প্রেমে ভালবাসি আবার ধরণীরে ।।


[বুদ্ধগয়া ২৩ আশ্বিন, ১৩২১]



                             সুপ্রভাত 

        এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ?
        আজি প্রাতে সূর্য - ওঠা সফল হল কার ?
কাহার আভিষেকের তরে                    সোনার ঘটে আলোক ভরে -
        উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার ?।
        বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা -
        কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা ?
বহু যুগের উপহারে                            বরণ করি নিল কারে ?
        কার জীবনে প্রভাত আজি ঘোচায় অন্ধকার ?।

[বুদ্ধগয়া ২৪ আশ্বিন, ১৩২১]



               পথের গান

পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
                       পথে চলাই সেই তো তোমার পাওয়া ।
যাত্রাপথের আনন্দ-গান যে গাহে
                      তারি কন্ঠে তোমারি গান গাওয়া ।
চায় না সেজন পিছন পানে ফিরে,
বায় না তরি কেবল তীরে তীরে -
তুফান তারে ডাকে আকুল নিরে
                      যার পরানে লাগলো তোমার হাওয়া
                      পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
                     পথিক-চিত্তে তোমার তরী বাওয়া ।
দুয়ার খুলে সমুখ পানে যে চাহে
                    তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া ।
বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
যাবার লাগি মন তারি উদাসে -
                      যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া ।
                      পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।

[বেলা ষ্টেশন, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]



                                  সাথি

                     পথের সাথি, নমি বারম্বার -
                     পথিকজনের লহো নমস্কার ।
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি,                   ওগো দিনশেষের পতি,
                     ভাঙা বাসার লহো নমস্কার ।।

অগ-নবপ্রভাত-জ্যোতি,                     ওগো চিরদিনের গতি,
                      নুতন আশার লহো নমস্কার ।
জীবন রথের হে সারথি,                       আমি নিত্য পথের পথী,
                     পথে চলার লহো নমস্কার ।।

[রেলপথে বেলা হইতে গয়ায়, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]


               জ্যোতি

ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
                  তোমারি হউক জয় ।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়,
                  তোমারি হউক জয় ।
হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে -
                  বন্ধন হউক ক্ষয় ।
                                 তোমারি হউক জয় ।
                         এস দুঃসহ, এস এস নির্দয় -
                                          তোমারি হউক জয় ।
                        এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয় -
                                          তোমারি হউক জয় ।

প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে ,
দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে,
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে -
                 মৃত্যুর হোক লয় ।
                                  তোমারি হউক জয় ।।

[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]


               কলিকা 

মুদিত আলোর কমলকলিটিরে
                রেখেছে সন্ধ্যা আঁধারপূর্ণপুটে ।
উতরিবে যবে নবপ্রভাতের তীরে
                তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে ।
উদয়াচলের সে তীর্থপথে আমি
চলেছি একেলা সন্ধ্যার আনুগামী,
                দিনান্ত মোর দিগন্তে পড়ে লুটে ।।

সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ
                আঁধার বাহিয়া রহিয়া রহিয়া আসে ।
আকাশে যে গান ঘুমাইছে নিষ্পন্দ
                তারাদীপগুলি কাঁপিছে তাহারি শ্বাসে ।
অন্ধকারের বিপুল গভীর আশা
অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষা
                বাণী খুঁজে ফিরে আমার চিত্তাকাশে ।।

জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
                নিশিথের পানে গহনে হয়েছে হারা ।
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিমেষে
                মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া ।

ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে
               একুল হইতে নবজীবনের কূলে
                            চলেছি আমার যাত্রা করিতে সারা ।।

হে মোর সন্ধ্যা , যাহা কিছু ছিল সাথে
            রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি ।
আঁধারের সাথি, তোমার করুণ হাতে
           বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখী ।
কত যে প্রাতের আশা ও রাতের গীতি
কত যে সুখের স্মৃতি ও দুঃখের প্রীতি
            বিদায়বেলায় আজিও রহিল বাকি ।।

যা-কিছু পেয়েছি, যাহা কিছু গেল চুকে,
             চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
যে মণি দুলিল যে ব্যাথা বিঁধিল বুকে,
             ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে,
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা -
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা
             পূর্ণের পদপরশ তাদের 'পরে ।।


[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]



                      অঞ্জলি

এই তীর্থদেবতার ধরণীর মন্দিরপ্রাঙ্গণে
যে পুজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে
সায়াহ্নের শেষ আয়োজন, যে পূর্ণ প্রণামখানি
মোর সারাজীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী
জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপমুখে ,
সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সন্মুখে
হে মোর অতিথি যত ! তোমরা এসেছ এ জীবনে
কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে শ্রাবনবরিষণে ।
কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ-বা কম্পিত দীপ শিখা
এনেছিল মোর ঘরে ; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা
বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে ।  যখন গিয়েছ চলে
দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে ।
আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম ;
রহিল পুজায় মোর তোমাদের সবার প্রণাম ।

[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩ কার্ত্তিক ১৩২১ ]




No comments:

Post a Comment