পরশমণি
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে,
এ জীবন পুন্য করো দহন দানে ।
আমার এই দেহ খানি তুলে ধরো ,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো -
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে ।
আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে ।।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারারাত ফোটাক তারা নব নব ।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো ,
যেখানে পরবে সেথায় দেখবে আলো -
ব্যাথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ-পানে ।
আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে ।।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
শরন্ময়ী
এই শরৎ আলোর কমল বোনে
বাহির হয়ে বিহার করে. যে ছিল মোর মনে মনে ।
তারই সোনার কাকন বাজে আজি প্রভাত কিরণ মাঝে ,
যাওয়ার কাপে আঁচলখানি — ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে ।
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুর তলে ।
হৃদয়-মাঝে হৃদয় দুলায় , বাহিরে সে ভুবন ভুলায় —
আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে ।।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
মোহন মৃত্যু
তোমার মহান রূপে কে রয় ভুলে !
জানি না কি মরন নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে !
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলো চুলে ।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে ?।
কাঁপন ধরে বাতাসেতে -
পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে উঠে ভরা ক্ষেতে ।
জানি গো আজ হাহারবে তোমার পুজা সারা হবে
নিখিল - অশ্রু - সাগর - কূলে ।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে ? ।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
শারদা
শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন আঙ্গুলি ।
শরৎ, তোমার শিশির - ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি ।।
মানিক - গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে ।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সংগীতে
ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গিতে -
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি ।।
[ সুরুল, ১৯ ভাদ্র ১৩২১]
জয়
মোর মরণে তোমার হবে জয় ।
মোর জীবনে তোমার পরিচয় ।
মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজ ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর আনন্দ সে যে মণিহার
মুকুটে তোমার বাঁধা রয় ।।
মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয় ।
মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয় ।
মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর বীর্য তোমার জয়রথ
তোমারি পতাকা শিরে রয় ।।
[ সুরুল, ২২ ভাদ্র ১৩২১]
ক্লান্তি
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো, প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পরি কভু ।
এই-যে হিয়া থরো থরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন - পানে তাকাই যদি কভু ।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পুজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।
[শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১]
পথিক
আমি পথিক, পথ আমার সাথি ।
দিন সে কাটায় গণি গণি বিশ্বলোকের চরণধ্বনি,
তারার আলোয় গায় সে সারা রাতি ।
কত যুগের রথের রেখা বক্ষে তাহার আকে লেখা,
কত কালের ক্লান্ত আশা
ঘুমায় তাহার ধুলায় আঁচল পাতি ।।
বাহির হলেম কবে সে নাই মনে ।
যাত্রা আমার চলার পাকে এই পথেরই বাঁকে বাঁকে
নুতন হল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ।
যত আশা পথের আশা, পথে যেতেই ভালবাসা -
পথে-চলার নিত্য রসে
দিনে দিনে জীবন ওঠে মাতি ।।
[শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১]
পুনরাবর্তন
আবার যদি ইচ্ছে কর আবার আসি ফিরে
দুঃখ সুখের ঢেউ খেলানো এই সাগরের তীরে ।
আবার জলে ভাসায় ভেলা, ধূলার 'পরে করি খেলা,
হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়নতীরে ।।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
আঘাত খেয়ে বাঁচি কিম্বা আঘাত খেয়ে মরি ।
আমার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে -
নুতন প্রেমে ভালবাসি আবার ধরণীরে ।।
[বুদ্ধগয়া ২৩ আশ্বিন, ১৩২১]
সুপ্রভাত
এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ?
আজি প্রাতে সূর্য - ওঠা সফল হল কার ?
কাহার আভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে -
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার ?।
বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা -
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা ?
বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে ?
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘোচায় অন্ধকার ?।
[বুদ্ধগয়া ২৪ আশ্বিন, ১৩২১]
পথের গান
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমার পাওয়া ।
যাত্রাপথের আনন্দ-গান যে গাহে
তারি কন্ঠে তোমারি গান গাওয়া ।
চায় না সেজন পিছন পানে ফিরে,
বায় না তরি কেবল তীরে তীরে -
তুফান তারে ডাকে আকুল নিরে
যার পরানে লাগলো তোমার হাওয়া
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথিক-চিত্তে তোমার তরী বাওয়া ।
দুয়ার খুলে সমুখ পানে যে চাহে
তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া ।
বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
যাবার লাগি মন তারি উদাসে -
যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া ।
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।
[বেলা ষ্টেশন, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]
সাথি
পথের সাথি, নমি বারম্বার -
পথিকজনের লহো নমস্কার ।
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি, ওগো দিনশেষের পতি,
ভাঙা বাসার লহো নমস্কার ।।
অগ-নবপ্রভাত-জ্যোতি, ওগো চিরদিনের গতি,
নুতন আশার লহো নমস্কার ।
জীবন রথের হে সারথি, আমি নিত্য পথের পথী,
পথে চলার লহো নমস্কার ।।
[রেলপথে বেলা হইতে গয়ায়, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]
জ্যোতি
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয় ।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়,
তোমারি হউক জয় ।
হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে -
বন্ধন হউক ক্ষয় ।
তোমারি হউক জয় ।
এস দুঃসহ, এস এস নির্দয় -
তোমারি হউক জয় ।
এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয় -
তোমারি হউক জয় ।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে ,
দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে,
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে -
মৃত্যুর হোক লয় ।
তোমারি হউক জয় ।।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]
কলিকা
মুদিত আলোর কমলকলিটিরে
রেখেছে সন্ধ্যা আঁধারপূর্ণপুটে ।
উতরিবে যবে নবপ্রভাতের তীরে
তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে ।
উদয়াচলের সে তীর্থপথে আমি
চলেছি একেলা সন্ধ্যার আনুগামী,
দিনান্ত মোর দিগন্তে পড়ে লুটে ।।
সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ
আঁধার বাহিয়া রহিয়া রহিয়া আসে ।
আকাশে যে গান ঘুমাইছে নিষ্পন্দ
তারাদীপগুলি কাঁপিছে তাহারি শ্বাসে ।
অন্ধকারের বিপুল গভীর আশা
অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষা
বাণী খুঁজে ফিরে আমার চিত্তাকাশে ।।
জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
নিশিথের পানে গহনে হয়েছে হারা ।
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিমেষে
মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া ।
ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে
একুল হইতে নবজীবনের কূলে
চলেছি আমার যাত্রা করিতে সারা ।।
হে মোর সন্ধ্যা , যাহা কিছু ছিল সাথে
রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি ।
আঁধারের সাথি, তোমার করুণ হাতে
বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখী ।
কত যে প্রাতের আশা ও রাতের গীতি
কত যে সুখের স্মৃতি ও দুঃখের প্রীতি
বিদায়বেলায় আজিও রহিল বাকি ।।
যা-কিছু পেয়েছি, যাহা কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
যে মণি দুলিল যে ব্যাথা বিঁধিল বুকে,
ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে,
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা -
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা
পূর্ণের পদপরশ তাদের 'পরে ।।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]
অঞ্জলি
এই তীর্থদেবতার ধরণীর মন্দিরপ্রাঙ্গণে
যে পুজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে
সায়াহ্নের শেষ আয়োজন, যে পূর্ণ প্রণামখানি
মোর সারাজীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী
জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপমুখে ,
সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সন্মুখে
হে মোর অতিথি যত ! তোমরা এসেছ এ জীবনে
কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে শ্রাবনবরিষণে ।
কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ-বা কম্পিত দীপ শিখা
এনেছিল মোর ঘরে ; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা
বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে । যখন গিয়েছ চলে
দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে ।
আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম ;
রহিল পুজায় মোর তোমাদের সবার প্রণাম ।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩ কার্ত্তিক ১৩২১ ]
আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে,
এ জীবন পুন্য করো দহন দানে ।
আমার এই দেহ খানি তুলে ধরো ,
তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো -
নিশিদিন আলোক-শিখা জ্বলুক গানে ।
আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে ।।
আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব
সারারাত ফোটাক তারা নব নব ।
নয়নের দৃষ্টি হতে ঘুচবে কালো ,
যেখানে পরবে সেথায় দেখবে আলো -
ব্যাথা মোর উঠবে জ্বলে উর্ধ-পানে ।
আগুনের পরশ-মণি ছোঁয়াও প্রাণে ।।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
শরন্ময়ী
এই শরৎ আলোর কমল বোনে
বাহির হয়ে বিহার করে. যে ছিল মোর মনে মনে ।
তারই সোনার কাকন বাজে আজি প্রভাত কিরণ মাঝে ,
যাওয়ার কাপে আঁচলখানি — ছড়ায় ছায়া ক্ষণে ক্ষণে ।
আকুল কেশের পরিমলে
শিউলিবনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুর তলে ।
হৃদয়-মাঝে হৃদয় দুলায় , বাহিরে সে ভুবন ভুলায় —
আজি সে তার চোখের চাওয়া ছড়িয়ে দিল নীল গগনে ।।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
মোহন মৃত্যু
তোমার মহান রূপে কে রয় ভুলে !
জানি না কি মরন নাচে, নাচে গো ওই চরণমূলে !
শরৎ-আলোর আঁচল টুটে কিসের ঝলক নেচে উঠে,
ঝড় এনেছ এলো চুলে ।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে ?।
কাঁপন ধরে বাতাসেতে -
পাকা ধানের তরাস লাগে, শিউরে উঠে ভরা ক্ষেতে ।
জানি গো আজ হাহারবে তোমার পুজা সারা হবে
নিখিল - অশ্রু - সাগর - কূলে ।
মোহন রূপে কে রয় ভুলে ? ।
[ সুরুল, ১১ ভাদ্র ১৩২১]
শারদা
শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন আঙ্গুলি ।
শরৎ, তোমার শিশির - ধোওয়া কুন্তলে
বনের পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি ।।
মানিক - গাঁথা ওই-যে তোমার কঙ্কণে
ঝিলিক লাগায় তোমার শ্যামল অঙ্গনে ।
কুঞ্জছায়া গুঞ্জরণের সংগীতে
ওড়না ওড়ায় একি নাচের ভঙ্গিতে -
শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি ।।
[ সুরুল, ১৯ ভাদ্র ১৩২১]
জয়
মোর মরণে তোমার হবে জয় ।
মোর জীবনে তোমার পরিচয় ।
মোর দুঃখ যে রাঙা শতদল
আজ ঘিরিল তোমার পদতল,
মোর আনন্দ সে যে মণিহার
মুকুটে তোমার বাঁধা রয় ।।
মোর ত্যাগে যে তোমার হবে জয় ।
মোর প্রেমে যে তোমার পরিচয় ।
মোর ধৈর্য তোমার রাজপথ
সে যে লঙ্ঘিবে বনপর্বত,
মোর বীর্য তোমার জয়রথ
তোমারি পতাকা শিরে রয় ।।
[ সুরুল, ২২ ভাদ্র ১৩২১]
ক্লান্তি
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো, প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পরি কভু ।
এই-যে হিয়া থরো থরো কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন - পানে তাকাই যদি কভু ।
দিনের তাপে রৌদ্রজ্বালায় শুকায় মালা পুজার থালায়,
সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো প্রভু ।।
[শান্তিনিকেতন, ১৬ আশ্বিন, ১৩২১]
পথিক
আমি পথিক, পথ আমার সাথি ।
দিন সে কাটায় গণি গণি বিশ্বলোকের চরণধ্বনি,
তারার আলোয় গায় সে সারা রাতি ।
কত যুগের রথের রেখা বক্ষে তাহার আকে লেখা,
কত কালের ক্লান্ত আশা
ঘুমায় তাহার ধুলায় আঁচল পাতি ।।
বাহির হলেম কবে সে নাই মনে ।
যাত্রা আমার চলার পাকে এই পথেরই বাঁকে বাঁকে
নুতন হল প্রতি ক্ষণে ক্ষণে ।
যত আশা পথের আশা, পথে যেতেই ভালবাসা -
পথে-চলার নিত্য রসে
দিনে দিনে জীবন ওঠে মাতি ।।
[শান্তিনিকেতন, ২১ আশ্বিন, ১৩২১]
পুনরাবর্তন
আবার যদি ইচ্ছে কর আবার আসি ফিরে
দুঃখ সুখের ঢেউ খেলানো এই সাগরের তীরে ।
আবার জলে ভাসায় ভেলা, ধূলার 'পরে করি খেলা,
হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়নতীরে ।।
কাঁটার পথে আঁধার রাতে আবার যাত্রা করি,
আঘাত খেয়ে বাঁচি কিম্বা আঘাত খেয়ে মরি ।
আমার তুমি ছদ্মবেশে আমার সাথে খেলাও হেসে -
নুতন প্রেমে ভালবাসি আবার ধরণীরে ।।
[বুদ্ধগয়া ২৩ আশ্বিন, ১৩২১]
সুপ্রভাত
এ দিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার ?
আজি প্রাতে সূর্য - ওঠা সফল হল কার ?
কাহার আভিষেকের তরে সোনার ঘটে আলোক ভরে -
উষা কাহার আশিস বহি হল আঁধার পার ?।
বনে বনে ফুল ফুটেছে, দোলে নবীন পাতা -
কার হৃদয়ের মাঝে হল তাদের মালা গাঁথা ?
বহু যুগের উপহারে বরণ করি নিল কারে ?
কার জীবনে প্রভাত আজি ঘোচায় অন্ধকার ?।
[বুদ্ধগয়া ২৪ আশ্বিন, ১৩২১]
পথের গান
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথে চলাই সেই তো তোমার পাওয়া ।
যাত্রাপথের আনন্দ-গান যে গাহে
তারি কন্ঠে তোমারি গান গাওয়া ।
চায় না সেজন পিছন পানে ফিরে,
বায় না তরি কেবল তীরে তীরে -
তুফান তারে ডাকে আকুল নিরে
যার পরানে লাগলো তোমার হাওয়া
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।
পান্থ তুমি, পান্থজনের সখা হে,
পথিক-চিত্তে তোমার তরী বাওয়া ।
দুয়ার খুলে সমুখ পানে যে চাহে
তার চাওয়া যে তোমার পানে চাওয়া ।
বিপদ বাধা কিছুই ডরে না সে,
রয় না পড়ে কোনো লাভের আশে,
যাবার লাগি মন তারি উদাসে -
যাওয়া সে যে তোমার পানে যাওয়া ।
পথে চলাই সেই তো তোমায় পাওয়া ।।
[বেলা ষ্টেশন, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]
সাথি
পথের সাথি, নমি বারম্বার -
পথিকজনের লহো নমস্কার ।
ওগো বিদায়, ওগো ক্ষতি, ওগো দিনশেষের পতি,
ভাঙা বাসার লহো নমস্কার ।।
অগ-নবপ্রভাত-জ্যোতি, ওগো চিরদিনের গতি,
নুতন আশার লহো নমস্কার ।
জীবন রথের হে সারথি, আমি নিত্য পথের পথী,
পথে চলার লহো নমস্কার ।।
[রেলপথে বেলা হইতে গয়ায়, ২৫ আশ্বিন, ১৩২১]
জ্যোতি
ভেঙেছ দুয়ার এসেছ জ্যোতির্ময়
তোমারি হউক জয় ।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়,
তোমারি হউক জয় ।
হে বিজয়ী বীর, নবজীবনের প্রাতে
নবীন আশার খড়গ তোমার হাতে,
জীর্ণ আবেশ কাটো সুকঠোর ঘাতে -
বন্ধন হউক ক্ষয় ।
তোমারি হউক জয় ।
এস দুঃসহ, এস এস নির্দয় -
তোমারি হউক জয় ।
এসো নির্মল, এসো এসো নির্ভয় -
তোমারি হউক জয় ।
প্রভাতসূর্য, এসেছ রুদ্রসাজে ,
দুঃখের পথে তোমার তূর্য বাজে,
অরুণবহ্নি জ্বালাও চিত্ত মাঝে -
মৃত্যুর হোক লয় ।
তোমারি হউক জয় ।।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]
কলিকা
মুদিত আলোর কমলকলিটিরে
রেখেছে সন্ধ্যা আঁধারপূর্ণপুটে ।
উতরিবে যবে নবপ্রভাতের তীরে
তরুণ কমল আপনি উঠিবে ফুটে ।
উদয়াচলের সে তীর্থপথে আমি
চলেছি একেলা সন্ধ্যার আনুগামী,
দিনান্ত মোর দিগন্তে পড়ে লুটে ।।
সেই প্রভাতের স্নিগ্ধ সুদূর গন্ধ
আঁধার বাহিয়া রহিয়া রহিয়া আসে ।
আকাশে যে গান ঘুমাইছে নিষ্পন্দ
তারাদীপগুলি কাঁপিছে তাহারি শ্বাসে ।
অন্ধকারের বিপুল গভীর আশা
অন্ধকারের ধ্যাননিমগ্ন ভাষা
বাণী খুঁজে ফিরে আমার চিত্তাকাশে ।।
জীবনের পথ দিনের প্রান্তে এসে
নিশিথের পানে গহনে হয়েছে হারা ।
অঙ্গুলি তুলি তারাগুলি অনিমেষে
মাভৈঃ বলিয়া নীরবে দিতেছে সাড়া ।
ম্লান দিবসের শেষের কুসুম তুলে
একুল হইতে নবজীবনের কূলে
চলেছি আমার যাত্রা করিতে সারা ।।
হে মোর সন্ধ্যা , যাহা কিছু ছিল সাথে
রাখিনু তোমার অঞ্চলতলে ঢাকি ।
আঁধারের সাথি, তোমার করুণ হাতে
বাঁধিয়া দিলাম আমার হাতের রাখী ।
কত যে প্রাতের আশা ও রাতের গীতি
কত যে সুখের স্মৃতি ও দুঃখের প্রীতি
বিদায়বেলায় আজিও রহিল বাকি ।।
যা-কিছু পেয়েছি, যাহা কিছু গেল চুকে,
চলিতে চলিতে পিছে যা রহিল পড়ে,
যে মণি দুলিল যে ব্যাথা বিঁধিল বুকে,
ছায়া হয়ে যাহা মিলায় দিগন্তরে,
জীবনের ধন কিছুই যাবে না ফেলা -
ধুলায় তাদের যত হোক অবহেলা
পূর্ণের পদপরশ তাদের 'পরে ।।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩০ আশ্বিন ১৩২১ ]
অঞ্জলি
এই তীর্থদেবতার ধরণীর মন্দিরপ্রাঙ্গণে
যে পুজার পুষ্পাঞ্জলি সাজাইনু সযত্ন চয়নে
সায়াহ্নের শেষ আয়োজন, যে পূর্ণ প্রণামখানি
মোর সারাজীবনের অন্তরের অনির্বাণ বাণী
জ্বালায়ে রাখিয়া গেনু আরতির সন্ধ্যাদীপমুখে ,
সে আমার নিবেদন তোমাদের সবার সন্মুখে
হে মোর অতিথি যত ! তোমরা এসেছ এ জীবনে
কেহ প্রাতে, কেহ রাতে, বসন্তে শ্রাবনবরিষণে ।
কারো হাতে বীণা ছিল, কেহ-বা কম্পিত দীপ শিখা
এনেছিল মোর ঘরে ; দ্বার খুলে দুরন্ত ঝটিকা
বার বার এনেছ প্রাঙ্গণে । যখন গিয়েছ চলে
দেবতার পদচিহ্ন রেখে গেছ মোর গৃহতলে ।
আমার দেবতা নিল তোমাদের সকলের নাম ;
রহিল পুজায় মোর তোমাদের সবার প্রণাম ।
[এলাহাবাদ, প্রভাত । ৩ কার্ত্তিক ১৩২১ ]
No comments:
Post a Comment